শেখ হাসিনা না থাকলে, কী হবে আওয়ামী লীগের?

শেখ আদনান ফাহাদ : এখনো শেখ হাসিনা সুস্থভাবে বেঁচে আছেন এবং দলীয় ও রাষ্ট্রীয় কাজে পুরোদমে সক্রিয় আছেন। তাই বেঁচে যাচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশ। উপ-কমিটিগুলোর নতুন পদধারীদের চিঠি পাঠাতে শুরু করেছিল দপ্তর। কিন্তু ছাত্রদলের নেতারা স্থান পেয়েছেন মর্মে অভিযোগ উঠলে, দপ্তর থেকে ঘোষণা দিয়ে এইসব কমিটি স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু কথা হল; এখন না হয় শেখ হাসিনা আছেন; শেখ হাসিনা দায়িত্ব ছেড়ে দিলে তখন কী হবে আওয়ামী লীগের? কীভাবে চলবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

সাংবাদিক হিসেবে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ বিট কাভার করেছি। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস উইং এ সংযুক্তি-ভিত্তিতে প্রায় তিন বছর কাজ করেছি। বাবা ভাষা সংগ্রামী আর মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় পারিবারিক কারণেও আওয়ামী লীগের সাথে যৎসামান্য রাজনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। তাছাড়া ছাত্রলীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির অনেকের সাথে উঠাবসা, সব মিলে নিজেকে বাংলাদেশের বিশাল আওয়ামী লীগ পরিবারের একজন অনানুষ্ঠানিক সদস্য বলেই মনে করি। তাই আওয়ামী লীগ নিয়ে কিছু কথা বলার অধিকার আমাদের আছে।

সুধাসদন, গণভবন, ধানমণ্ডি-৩ এর সভানেত্রীর কার্যালয়ে কারণে-অকারণে প্রায়শ যাতায়াত আছে আমার। পার্টির বাইরে, ভেতরে কী হচ্ছে কিছু খবর আমাদের কানেও আসে। কিন্তু যেহেতু পার্টির কেউ নই, খুব বেশী কথা বলার সুযোগ নেই। তদুপরি, ভুল জায়গায় সঠিক কথা বললেও নিগৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতভাগ। তাই রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে কিছু কথা ক্লাসরুম, পরিবার আর ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবদের কাছে বলেই স্বীয় অশান্ত মনকে তুষ্ট রাখতে হয়। ক্ষমতাসীন পার্টি নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখালে, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষের অনেকে মনে করে, অন্য অনেকের মত আমরাও বুঝি ধান্দাবাজ। কিন্তু কার ভয়ে, কিসের ভয়ে চুপ করে থাকব? কেন চুপ করে থাকব? এত ভয় নিয়ে চুপচাপ বসে ধ্বংস দেখার অপেক্ষার কষ্ট সহ্য করার চেয়ে সত্য অনুধাবন প্রকাশ করে ফেলা উচিত। কারণ আওয়ামী লীগ ধ্বংস হলে বাংলাদেশ ধ্বংস হবে। এই বাংলাদশের জন্ম হয়েছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে।

শেষের ঘটনা দিয়েই শুরু করি। ধানমণ্ডি তিন নাম্বারে সভানেত্রীর কার্যালয়ই মূলত দলীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গুলিস্তানের ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউর পার্টি অফিসে বহুদিন যাওয়া হয় না অনেকের। দলীয় নেতারা যেখানে যাবেন, কর্মীরাও সেখানে ভিড় করবেন, এটাই স্বাভাবিক। গত কয়েক মাস ধরে তিন নাম্বারের অফিসে গেলেই দেখা যায় পরিচিত অনেক বড় ভাই, বন্ধু, ছোটভাইদের ভিড়। আমার পরিচিতদের বেশীরভাগই ছাত্রলীগের সাবেক নেতা।

শেখ আদনান ফাহাদ

সর্বশেষ কাউন্সিলের পর থেকে আওয়ামী লীগের নানা উপ-কমিটিতে স্থান পেতে দীর্ঘদিন থেকে নেতাদের দরবারে হাজিরা দিয়ে চলেছেন এরা। কেউ আগের উপ-কমিটিগুলোতে সহ-সম্পাদক বা সদস্য হিসেবে ছিলেন, অনেকে আগের কমিটিতেও ছিলেন না। কেউ বেসরকারি কলেজে চাকরি করছেন, কেউ ছোট-খাট ব্যবসা করছেন, অনেকে আছেন অর্থকরী কিছুই করছেন না। এভাবেই চলছে বহুদিন ধরে। কোনো কোনোদিন ভিড় খুব বেশি বেড়ে যায়। ঐদিনগুলোতে গুজব থাকে যে, আজই কমিটি দিয়ে দেবে। সন্ধ্যার পর বড় নেতারা চলে গেলে, ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যায় অফিস। মাঝখানে একবার পত্রিকার মারফত আমরা জানতে পারলাম, চার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে একটি উপ-কমিটির সদস্য করা হয়েছে। পরিস্থিতি গরম হয়ে গেলে, বিবৃতি দিয়ে সে খবর সত্য নয় বলে জানায় পার্টির দপ্তর বিভাগ।

অনেক অপেক্ষার পর গত দুইদিন ধরে ফেসবুকে দেখা গেল, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ এর স্বাক্ষরিত অনেকগুলো চিঠি। যারা পোস্ট পেয়েছে, তাদেরকে অন্যরা শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল, সাবেক ছাত্রলীগের অনেক পদধারীর মনে হয় পদ মিলেছে। কিন্তু পরে ধীরে ফেসবুকসহ বাস্তবের পৃথিবীতেও হতাশা ছড়িয়ে পড়ল। ছাত্রলীগের সোহাগ-নাজমুল কমিটির একজন কেন্দ্রীয় নেতা নিজেকে ফেসবুকে ‘রোহিঙ্গা’ বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মনের ভেতরে কতখানি কষ্ট থাকলে, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নিজেকে হতভাগা রোহিঙ্গাদের কাতারে কল্পনা করতে পারেন। ছাত্রলীগের এই নেতাকে আমি ভালোভাবেই চিনি ও জানি। এক সাংবাদিকের মাধ্যমে জানতে পারলাম, দপ্তর উপ-কমিটিতে তিন নম্বর অফিসের স্টাফকেও সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। অফিসের স্টাফ যদি কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের নেতা হয়ে যান, তাহলে জানতে ইচ্ছে করে, আওয়ামী লীগের পোস্ট প্রাপ্তির যোগ্যতা কী?

সবচেয়ে বিস্ময়কর খবর হল, উপ-কমিটিতে নাকি বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের কয়েকজন সাবেক নেতা স্থান পেয়েছেন। দপ্তর সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ উঠেছে, তিনি গঠনতন্ত্র না মেনে জেলা কমিটির সদস্যদেরও কেন্দ্রীয় উপকমিটিতে ঢুকিয়েছেন। আব্দুস সোবহানের নাম এককভাবে বলা হচ্ছে, কারণ সবগুলো কাগজে শুধু উনার স্বাক্ষরই দেখা গেছে। দলীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ইতোমধ্যেই গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এসব কমিটির দায়-দায়িত্ব তিনি নেবেন না, কারণ তিনি কোথাও স্বাক্ষর করেননি। সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্যও কম বিস্ময়কর নয়। কারণ দলের সাধারণ সম্পাদক যেসব কমিটির দায়-দায়িত্ব নেবেন না, সে কমিটির বৈধতা থাকে কীভাবে?

সবগুলো কমিটির কাগজেই সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষর থাকার কথা। দলীয় সভাপতির স্বাক্ষর থাকলে আরও ভালো। কারণ এগুলো কোনো ওয়ার্ড কমিটি বা থানা কমিটি নয়; জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। কেন্দ্রীয় কমিটিতে কে ঢুকছে, তাঁদের কী যোগ্যতা, তাদের অতীত কী, বর্তমান কী এগুলো নিশ্চয় দলীয় প্রধানের জানা থাকার কথা। প্রাপ্ত কমিটিগুলোর কাগজে শুধু দপ্তর সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপের স্বাক্ষর দেখা গেছে। আমরা সাধারণ মানুষ, সাধারণ ভাবে চিন্তা করি। গোলাপ সাহেব দপ্তর সম্পাদক। দলীয় সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষর ছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির মূল কমিটি হোক আর উপ-কমিটি হোক, কোনো কমিটিই বৈধ হওয়ার কথা না।

সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত খবর অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের এক সাংগঠনিক সম্পাদকের সহ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পেয়েছেন তিন জন। তাদের মধ্যে ছাত্রদলের ক্যাডারও রয়েছে। সহসম্পাদক ও উপ কমিটির সদস্যদের মধ্যে রিয়াজ এবং এস ডি রুবেল ঠাঁই পেয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে। রিয়াজ ছাত্রদলের ঢাকা কলেজ শাখার ক্যাডার ছিলেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের অনুমোদিত উপ-কমিটিতে সংস্কৃতি বিষয়ক উপ-কমিটির তিন নম্বর সদস্য হিসেবে আছেন জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী এস ডি রুবেল। এস ডি রুবেল বিএনপির সাংস্কৃতিক সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) দীর্ঘ দিন কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। এ ছাড়া ছাত্রজীবনে ঢাকা কলেজে ছাত্রদলের নেতা ও ক্যাডার হিসেবে পুরো ছাত্রজীবন পার করেছেন। এমনকি এস ডি রুবেল ছাত্রদলের ঢাকা কলেজ শাখার সাংস্কৃতিক সম্পাদকও ছিলেন বলে সংবাদমাধ্যম খবর প্রচার করেছে।

মাস কয়েক আগে আমরা দেখলাম, চট্টগ্রামের এক জামাত নেতার মেয়ে, যে কি না যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির পরে গায়েবানা নামায পড়িয়েছিল, তার মেয়েকে মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির লিডার বানানো হয়েছে। আর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কিছু নেতার হাত ধরে জামাত-শিবিরের কয়েক শ নেতা-কর্মী আওয়ামীলীগ এবং ছাত্রলীগেও প্রবেশ করেছে মর্মে বহু সংবাদ প্রতিবেদন আমরা পড়েছি।

এভাবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে যদি বিএনপি-জামাতের লোকজনকে পোস্ট দেয়া হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী? কেন্দ্রীয় কমিটির যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ের কী অবস্থা নিয়ে ভাবলে মাথা পুরো নষ্ট হয়ে যায়। এখনো শেখ হাসিনা সুস্থভাবে বেঁচে আছেন বিধায়, ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশ। স্বস্তির খবর হল, শেখ হাসিনার কানে আওয়ামী লীগের উপ-কমিটির খবর গেছে। নতুন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে শেখ হাসিনা আমাদের দৃষ্টিতে এমন কিছু মানুষকে জায়গা দিয়েছেন যারা প্রকৃত অর্থেই রাজনীতিবিদ এবং তৃণমূলের সাথে গভীর সম্পর্ক তাঁদের। এখন উপ কমিটির প্রতিটি পদও যোগ্যদের দেয়া উচিত।

রাজনীতিবিদদের মানুষ এখন বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু শেখ হাসিনাকে শুধু আওয়ামী লীগের নয়, দেশের সাধারণ মানুষের অনেক বড় একটা অংশ বিশ্বাস করে, ভালোবাসে। একাধিক জরিপে প্রমাণিত হয়েছে, দল এবং সরকার থেকেও দেশের মানুষের মাঝে বেশী জনপ্রিয় শেখ হাসিনা। এই ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস শেখ হাসিনা নিজের কর্ম দিয়ে অর্জন করে নিয়েছেন। সারা বিশ্ব এখন আমাদের একজন নেতাকেই জানে, তিনি হলেন শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে, দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ করব, উপকমিটি গুলো নিয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেয়া হোক। রাজনীতিসংশ্লিষ্ট এবং অবশ্যই শুধু বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত অনুসারীদের এসব কমিটিতে স্থান দেয়া হোক। বঙ্গবন্ধু ‘কোটারি’ করতে নিষেধ করে গেছেন, অথচ আওয়ামীলীগের কোনো কোনো নেতার একমাত্র কাজ হল কোটারি করা। যত সিভি জমা পড়েছে, সবগুলো আবার পুনঃযাচাই করে প্রতিটি উপ-কমিটি আবার নতুন করে দেয়া হোক। আমরা সকলেই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব, কিন্তু আওয়ামীলীগ যেন কেয়ামত পর্যন্ত থাকে, সেভাবেই কাজ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা ইতোমধ্যে একাধিকবার বলেছেন, আগামী নির্বাচনের পরে দলের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন। শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ সক্রিয় থাকা অবস্থায় দলের ভেতরে এই অবস্থা, যেদিন তিনি থাকবেন না, তখন দলের কী হবে সেটা ভেবে আতংকিত হতে হয়। আমরা চিন্তায় আছি। কারণ আওয়ামী লীগ পথ হারালে, বাংলাদেশও পথ হারাবে।

লেখকঃ সাংবাদিক ও শিক্ষক