একটি স্বপ্নের পথচলা
সারাবিশ্বে লক্ষ ওয়েব সাইটের চেহারা দিয়েছেন যিনি
ওয়েব দুনিয়ায় বিচরন করেন আর ওয়ার্ডপ্রেসের নাম শোনেননি এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বা সিএমএস হিসাবে ওয়ার্ডপ্রেস স্বীকৃত। শক্তিশালী ব্লগ ইঞ্জিন হিসাবে ওয়ার্ডপ্রেসের ব্যবহার সবচেয়ে বেশী। পৃথিবীর নামী দামী অনেক কোম্পানি, সংবাদপত্র, মিডিয়া, ব্যক্তি ওয়ার্ডপ্রেস ইঞ্জিনের উপর তাদের ওয়েব সাইট বানিয়েছেন। বর্তমানে ব্যবহৃত ওয়েবসাইটের ৪১.১% ওয়ার্ডপ্রেস দিয়ে তৈরি। সহজে সার্চ ইঞ্জিন ফ্রেন্ডলি হওয়ায় ওয়ার্ডপ্রেস ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এই সংখ্যা বৃদ্ধির হার যেখানে ২০১১ সালে ছিল ১৩.১০% সেখানে ২০২১ সালে এসে তা হয়েছে ৪০.১%। প্রখ্যাত অনেক প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, কোম্পানি এই ওয়ার্ডপ্রেসকে তাদের ওয়েবসাইটের জন্য ব্যবহার করে।
ওয়ার্ডপ্রেসের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হচ্ছে এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা যা অন্যান্য সিএমএস গুলোর চেয়ে বেশ কার্যকরী ও উন্নতমানের। এজন্য সিএমএস ব্যবহার করা সাইটগুলোর মধ্যে ৬৪.৩০% সাইট ওয়ার্ডপ্রেস ব্যবহার করে তৈরি করা হয় যেখানে ওয়ার্ডপ্রসের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শপিফাই এর মার্কেট শেয়ার মাত্র ৩.৩%। ওয়ার্ডপ্রেসের হাজার হাজার থিম ও প্লাগিন্স ব্যবহারকারীকে দেয় পূর্ণ স্বাধীনতা। ওয়ার্ডপ্রেস থিমগুলো মূলত ওয়েবসাইটের কাঠামো ও পোষাক। এগুলোই নির্ধারন করে কোন ওয়েবসাইটের চেহারা কেমন হবে, কোন ওয়েবসাইটের বৈশিষ্ট্য কেমন হবে। ব্যাবহারকারী হাজার হাজার থিমের ভিতর থেকে তার পছন্দসই থিমিটি বেছে নেন। এভাবেই কোটি কোটি ওয়েবসাইটের জন্য তৈরি হয়েছে হাজার হাজার থিম। ব্যাবহারকারীরা বিনামূল্যে ও মূল্যের বিনিময়ে সেগুলো পেয়ে থাকে। ওয়ার্ডপ্রেস সেই হাজার হাজার থিম থেকে প্রতি সপ্তাহে সেরা থিমগুলোকে নির্বাচন করে। বিশ্বের নামী দামী ডেভেলপার ও কোম্পানির থিমগুলো মূলত সেখানে স্থান পায়। সেই নির্বাচিত প্রথম ১০ এর তালিকায় বাংলাদেশী কোন মানুষের থিম প্রথমবারের মত স্থান পায় ২০১২ সালে। সেই থেকে বেশ কয়েক বারই সেই তালিকায় আসে বাংলাদেশী থিম ডেভলপার ডি ফাইভ ক্রিয়েশন এর ডেভেলপ করা কয়েকটি থিম। ওয়ার্ডপ্রসের বৈশ্বিক ফিচার্ড তালিকাতেও ডি ফাইভ ক্রিয়েশনের থিম অনেকবার তালিকাভূক্ত হয়েছে। ডি ফাইভ ক্রিয়েশানের ওয়েবসাইট ঠিকানাঃ https://d5creation.com
বিশ্বের কয়েক লক্ষ মানুষ ও প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ব্যবহার করছে এই ডি ফাইভ ক্রিয়েশনের ডেভেলপ করা থিম। হাজার হাজার মানুষের প্রশংসাসূচক বার্তায় সিক্ত বাংলাদেশী এই উদ্যোগ। এই উদ্যোগ যিনি নিয়েছেন তিনি এস, এম, সাইফুর রহমান। ২০০৯ সালে যখন জার্মান সরকারের একটা শিক্ষাবৃত্তি প্রায় চূড়ান্ত তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন বিদেশে না গিয়ে নিজ দেশে থেকেই কিছু করার। তার পরিবার ও পরিচিতজনেরা যখন তাকে পরামর্শ দেন বিদেশে উন্নত জীবন কে বেছে নিতে তখন তিনি তাদেরকে বলেন দেশে থেকেই বিদেশের উপার্জন সম্ভব। তিনি সেটা প্রমান করেছেন। তার সম মেধার একজন মানুষ বিদেশে যে উপার্জন করতে পারেন তিনি দেশে থেকেই সেটা পারছেন। পাশাপাশি তিনি অনেক বেকার যুবক ও মেধাবীদের জন্য খুলে দিয়েছেন সম্ভাবনার দূয়ার। তার তৈরি থিম এখন ব্যবহৃত হচ্ছে সারাবিশ্বের কয়েক লক্ষ ওয়েব সাইটে। ওয়ার্ডপ্রেসে তার ডেভেলপ করা বর্তমান থিমের সংখ্যা ৫৬ যা কোন একক ডেভেলপারের করা সর্বোচ্চ সংখ্যক থিমগুলোর তালিকায় আছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ তার তৈরি এই সমস্ত মুক্ত থিম দিয়ে তাদের ওয়েব সাইট তৈরি করছেন। যার বেশি বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন থিম প্রয়োজন তিনি নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করে উন্নত ভার্সন কিনে নিচ্ছেন।
জনাব সাইফ আমাদের জানান, তার তৈরি থিম বর্তমানে প্রায় ৩৫০,০০০ ওয়েবসাইটে ব্যবহৃত হচ্ছে যার মধ্যে শত শত গৌরবজনক ওয়েবসাইটও আছে। তিনি জানালেন, তার কাছে সংরক্ষিত তালিকা অনুযায়ী University of Denver (DU), Unmanned Systems Research Institute (du2sri.du.edu); TELL Research Lab, University of Missouri (tell.missouri.edu); Geology and Geophysics, University of Utah (rocklab.earth.utah.edu); Laboratory for Biologically Inspired Photonic Engineering, MIT (bioinspiredoptics.mit.edu); Covid Control Study, John Hopkins University (covidcontrol.jhu.edu); Daily Business UK (dailybusinessgroup.co.uk); Tonga Broadcasting Commission (tonga-broadcasting.net); Margaret Atwood (margaretatwood.ca); Pulm Foods (plumfoods.com.au); Tampa Bay Reporter (tbreporter.com); Sarah Watching (sarahwatching.com); Department of Agriculture, Government of Thailand (doa.go.th/en); The Music City Review (musiccityreview.com); Morocco Immersion (moroccoimmersion.com); Uganda Wildlife Research and Training Institute (uwrti.ac.ug); U.S. Hedge Funds (ushedgefunds.com); Divina Christian Broadcast Academy (divinacba.com); Southwest Florida Hero Fest (swflherofest.com); Inversions & Industrial Arenas (industriasarenas.com); Dr. David E. Smith (beliefsandethics.com); Montana Innovation Partnership (montanainnovationpartnership.org) এর মতো বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারী প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি, স্টার্ট-আপ কোম্পানি তার তৈরি থিমে তাদের ওয়েবসাইট বানিয়েছে। এই তালিকায় আরো আছে বাহামার অর্থ মন্ত্রনালয়, দুইবার বুকার পুরষ্কার পাওয়া কানাডিয়ান লেখিকা মার্গারেট এ্যাটউড যিনি বেশ কয়েক বছর ধরে নোবেল সাহিত্য পুরষ্কারের সম্ভাব্য শীর্ষ তালিকার প্রথমে থাকেন, বিখ্যাত হলিউড অভিনেতা ডেভ মুর সহ আরও অনেক সাইট।
তার উদ্যোগের সঙ্গে বর্তমানে কাজ করছেন নিয়মিত ৪ জনসহ অনিয়মিত ১০ জন ছেলেমেয়ে। তারাও হয়েছেন স্বাবলম্বী। তার অসংখ্য অনুসারী বর্তমানে তার থেকে অনুপ্রানিত হয়ে হয়েছেন সাবলম্বী। তিনি তার পঠিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গরীব মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনাকে নিয়মিত করতে শিক্ষাবৃত্তি চালু করার উদ্যোগ নিয়েছেন ও নিয়মিত শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে থাকেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অনেক সমাজসেবী সবেচ্ছাসেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে তিনি বিনামূল্যে সহযোগীতা দিয়ে থাকেন। বিশ্বের অনেক ব্যক্তি ও ছোট কোম্পানি তার তৈরি থিমের মাধ্যমে তাদের গ্রাহকদের ওয়েবসাইট ডেভেলপ করে পরিবার ও কোম্পানির সার্বিক ব্যায় নির্বাহ করছেন। তাদের নামের তালিকা চাইলে জনাব সাইফ গোপনীয়তার নীতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে সেটা প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তিনি কিছু উদাহরন দেখিয়েছেন যার মধ্যে ইতালি, বেলজিয়াম, ইউকে, কানাডার কিছু ব্যক্তি ও কোম্পানি আছে।
প্রযুক্তি পাগল মানুষটি তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশুনার সুযোগ না পেলেও নিজ প্রচেষ্টায় তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দক্ষতাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যা বর্তমানে অনেকের জন্য অনুপ্রেরনার উৎস। ২০০৬ সালে তিনি ইমেজ র্যাক নামক একটি সফটওয়ার তৈরি করেন যা দিয়ে একটি বড় আকারের ম্যাপ কে সহজে জিআইএস এর মাধ্যমে পৃথিবীর অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের সঙ্গে সমন্বয় করা যায়। সে সময় সেই সফটওয়্যার ব্যাবহার করে এল জি আর ডির কমিউনিটি বেসড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের জন্য শত শত ম্যাপ প্রস্তুত করা হয় যা সরকারীভাবে করা দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের অবস্থান ও ব্যাবস্থাপনার প্রথম ডিজিটাল উদ্যোগ।
ছোটবেলা থেকেই তিনি প্রযুক্তিমনস্ক। ১৯৯৭ সালে কম্পিউটারে হাতেখড়ি। বাবা, মা ও নানীর ক্ষুদ্র সঞ্চয়, তার বৃত্তির টাকা সব এক যোগ করে ২২০০০ টাকা দিয়ে প্রথম কম্পিউটার কেনেন ২০০৩ সালে। তার আগে বিভিন্ন বন্ধুর কম্পিউটার ও বিশ্ববিদ্যালয় এর ল্যাবে প্রোগ্রামিং শেখা শুরু করেন। ২০০৩ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনাকালীন বায়োস্কোপ এক্স পি নামক একটা সফটওয়্যার উদ্ভাবন করে তিনি বেশ সাড়া ফেলে দেন। ১০ই অক্টোবর ২০০৩ তারিখে প্রথম আলোর প্রজন্ম ডট কম পাতায় তিনি ও তার উদ্ভাবিত সফটওয়্যার নিয়ে একটি ফিচার প্রকাশ হলে তিনি বেশ আলোচিত হন সারাদেশে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি স্কুলের ডিন তাকে বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংবর্ধনা দেন। বায়োস্কোপ ছিল একটি মিডিয়া প্লেয়ার যা সমসাময়িক প্লেয়রগুলোর অনেক সীমাবদ্ধতাকে পিছনে ফেলে নতুন অনেক বৈশিষ্ট্য যোগ করে। সেই থেকে প্রযুক্তির সঙ্গে তার পথচলা।
তথ্য প্রযুক্তিতে কোন রকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই তিনি শুধুমাত্র নিজের একাগ্রতা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে প্রোগ্রামিং শিখেছেন। তার স্বপ্ন নিজের এলাকার মেধাবী ছেলেমেয়েদের জন্য একটা তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষার একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা যার মাধ্যমে তিনি তার এলাকার বেকারদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং কে জনপ্রিয় করে, তাদেরকে দক্ষ করে দারিদ্র্য বিমোচন করতে চান। তার এই স্বপ্নের পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা গ্রাম পর্যায়ে দূর্বল ইন্টারনেট ব্যবস্থা। থ্রি জি প্রযুক্তি গ্রাম পর্যায়ে ছড়ালে তিনি এটা শুরু করবেন।
তার ভবিষ্যৎ ভাবনা হল গ্রাম পর্যায়ে তিনি একটি অফিস প্রতিষ্ঠা করবেন যা হবে গ্রামীন আবহে তৈরী এক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এবং যেখানে তৈরী হবে ওয়ার্ডপ্রেস ও অন্যান্য মুক্ত সফটওয়্যারের বিশ্বসেরা টুলস।
তার তৈরি থিমে লক্ষ লক্ষ ওয়েবসাইট থাকলেও তাকে সবচেয়ে বেশী আবেগী করেছিল তার থিমে তৈরি হুইল চেয়ার ট্রাভেলার্সদের একটি সাইট যারা শারিরীক প্রতিবন্ধীদের একা একা বিশ্বভ্রমনে নানান সহযোগীতা দিয়ে থাকে। শারিরীক, মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য তার আলাদা দরদ কাজ করে। তিনি বললেন কোন জাতির সভ্যতার মান বোঝা যায় তারা তাদের প্রতিবন্ধী, নারী, শিশু ও সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কেমন আচরন করে তা দিয়ে। নিজে একজন ভ্রমন পিপাসু মানুষ। নিজ খরচে একাধিকবার ভ্রমন করেছেন ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড মালয়েশিয়া। বিশ্বভ্রমনের শখ পূরণ করবেন তিনি, এই আগ্রহও জানালেন। তার একটি ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট রয়েছে যেখানে তিনি তার দৈনন্দিন ভাবনা, সমাজচিন্তা, প্রযুক্তি কথন এগুলো নিয়মিত লিখে থাকেন। সেই সাইটের ঠিকানাঃ https://smsaif.me
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন