সিনহার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সুরাহা করবে কে?

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে ওঠা ১১টি অভিযোগের বিষয়ে এখনো অনুসন্ধান শুরু হয়নি। যদিও সপ্তাহ তিনেক আগে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছিলেন, এসব অভিযোগের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান করবে, আর সত্যতা পাওয়া গেলে নেয়া হবে ব্যবস্থা।

প্রধান বিচারপতি বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত আপিল বিভাগের পাঁচ জ্যেষ্ঠ বিচারক তার সঙ্গে এজলাসে বসতে রাজি নন। আবার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা হওয়ায় বিচারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কর্তৃত্ব এখন সংসদের নেই। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এখনও গঠন হয়নি। এই অবস্থায় দুদক যদি অনুসন্ধান না চালায় তাহলে বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সত্য কি মিথ্যা- সে মীমাংসা তার পদে থাকার মেয়াদের মধ্যে হবে কি না সে প্রশ্নের জবাব নেই কারও কাছে।

২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের ২১তম প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করা সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদের মেয়াদ আছে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি দেশে ফিরলেও তার দায়িত্ব গ্রহণ সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন বিচারালয় সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘একটু অপেক্ষা করেন, দেখুন কী হয়। এটা তো আর রাস্তায় রাস্তায় বলার বিষয় না। রাষ্ট্রপতি বিষয়টি দেখছেন।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির পদটি সাংবিধানিক। ওনার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তার সব রাষ্ট্রপতির কাছে আছে। তিনি এসব অভিযোগ জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের দেখিয়েছেন। তারা এতটাই বিব্রত হয়েছেন যে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তারা বসতেও চাননি। এসব অভিযোগের মীমাংসা হবেই।’

গত ১৩ অক্টোবর এক মাসের ছুটিতে প্রধান বিচারপতি এক মাসের ছুটিতে দেশের বাইরে যাওয়ার পর দিন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অর্থপাচার, নৈতিক স্খলনসহ এসব অভিযোগে কথা জানা যায়। সুপ্রিম কোর্ট বিবৃতি দিয়ে সব কিছু প্রকাশ করে তারও পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, এসব অভিযোগের অনুসন্ধান করবে দুর্নীতি দমন কমিশন।

সুপ্রিম কোর্টের বিবৃতিতে জানান হয়, সিনার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে তার মধ্যে আছে বিদেশে অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, নৈতিক স্খলন প্রভৃতি। তারও একদিন পর ১৫ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘(প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে) যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, এর সবগুলোই দুর্নীতি দমন কমিশনের আওতায় তাহলে আপনারা বুঝতেই পারছেন কে অনুসন্ধান করবে।’

‘কোনো অভিযোগের অনুসন্ধান দুদক নিজেও করতে পারে বা কেউ তাদের কাছে পাঠাতে পারে।’

দুদকে অনুসন্ধানের জন্য আপনারা পাঠাবেন কি না? এ প্রশ্নে সেদিন মন্ত্রী বলেন, ‘সেটার ব্যাপারে বিবেচনা করব।’

আইনমন্ত্রীর ওই সংবাদ সম্মেলনের পর পেরিয়ে গেছে তিন সপ্তাহ। কিন্তু ঘটনা যেখানে ছিল, সেখানেই রয়ে গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন এখনো এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়নি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সংস্থাটির উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য।

অবশ্য আইনমন্ত্রী যেভাবে বলেছেন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চালানো ততটা সহজ হবে না বলে মনে করেন আইনজীবীদের একাংশ।

জানতে চাইলে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘প্রাইমাফেসিতে আমার মনে হচ্ছে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চালানোতে আইনগত বাধা আছে। এটা আমার ব্যক্তিগত মত। তবে বিষয়টি নিয়ে আরো আলাপ আলোচনা করা যেতে পারে।’

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া রায়ে সংসদ, শাসনব্যবস্থা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে করা নানা মন্তব্যের কারণে তার তীব্র সমালোচনা করে আসছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। বিএনপির অভিযোগ, ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায় বিপক্ষে যাওয়ায় প্রধান বিচারপতি সরকারের রোষানলে পড়েছে। তবে সরকার বলছে, আইনের শাসনে অভিযোগ উঠলে সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হয়। প্রধান বিচারপতিও আইনের ঊর্ধ্বে নয়।

সুপ্রিম কোর্টের বিবৃতিতে যা জানানো হয়েছিল

গত ২ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে লেখা চিঠিতে প্রধান বিচারপতি অসুস্থতার কারণ জানিয়ে এক মাসের ছুটি চান। তবে ১৩ অক্টোবর দেশের বাইরে যাওয়ার সময় গণমাধ্যমকর্মীদের দেয়া বিবৃতিতে সিনহা বলেন, তিনি অসুস্থ নয় এবং দেশে ফিরে এসে আবার তার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।

এর পরদিন সুপ্রিম কোর্ট থেকে দেয়া বিবৃতিতে জানান হয়, সিনহার বিরুদ্ধে ১১টি গুরুতর অভিযোগ আছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের চারজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিতে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে এগুলো তাদের হাতে তুলে দেন। সেদিন দেশের বাইরে থাকা বিচারপতি ইমান আলী ও অপর চার বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এবং বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার বিচারপতি সিনহার সঙ্গে বৈঠক করে এসব বিষয়ে জানতে চান। কিন্তু তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

গত ১ অক্টোবর সিনহার সঙ্গে ওই বৈঠক হয় পাঁচ বিচারপতির। সেদিন সন্তোষজনক জবাব না পেয়ে পাঁচ বিচারপতি জানান, এসব অভিযোগের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সিনহার সঙ্গে বসে বিচারকার্য পরিচালনা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।

ওই দিন প্রধান বিচারপতি সিনহা পাঁচ বিচারপতিকে জানান, তিনি এসব অভিযোগের সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারলে পদত্যাগ করবেন এবং এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানান হবে ২ অক্টোবর। কিন্তু ওই দিন পাঁচ বিচারপতিকে কিছু না জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে এক মাসের ছুটির আবেদন করেন প্রধান বিচারপতি সিনহা।রাষ্ট্রপতি সেই ছুটির অনুমোদন করেন এবং পরে ছুটির মেয়াদ ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বাড়ান হয়।-ঢাকাটাইমসের সৌজন্যে