সিরিয়াতে কেমন ছিল সেই আইএস দম্পতির জীবন

ইসলামিক স্টেটে যোগ দেওয়ার পেছনে কী কারণ ছিল সেটা বলতে গিয়ে শামীমা বেগম বলেছেন, নিখুঁত একটি পারিবারিক জীবনের খোঁজে তিনি ব্রিটেন থেকে সিরিয়াতে গেছেন।

ছুটে গেছেন আই এসের স্বঘোষিত রাজধানী রাক্কায়, বছর চারেক আগে।

সেখানে পৌঁছানোর পর তিনি একজন জিহাদিকে বিয়ে করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করলে জঙ্গি গ্রুপটি তাদেরই একজন ডাচ যোদ্ধা ইয়াগো রিয়েডিকের সাথে বিয়ের আয়োজন করে।

তখন শামীমা বেগমের বয়স ছিল ১৫ এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী মি. রিয়েডিকের ২৩।

শামীমা বেগমের নিজের দেশ যুক্তরাজ্যে ১৫ বছরের কোন মেয়েকে বিয়ে করলে একজন পুরুষ ধর্ষণের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হতেন।

মি. রিয়েডিকের বয়স এখন ২৭। বিবিসির সংবাদদাতা কোয়েন্টিন সমারভিল যখন তার সাক্ষাৎকার নেন তখন তিনি কুর্দিদের একটি শিবিরে বন্দী ছিলেন।

সাক্ষাৎকার শুরু করার আগে কারারক্ষী তার হাতকড়া খুলে দিয়েছিল।

মি. রিয়েদিক তখন বিবিসির সাংবাদিককে বলেন, “আপনার যদি শামীমার সাথে দেখা হয় তাহলে তাকে বলবেন আমি তাকে ভালোবাসি। তাকে ধৈর্য ধরতে বলবেন।”

“আশা করছি খুব শীঘ্রই আমরা আবার একত্রিত হবো এবং সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।” যদিও নিকট ভবিষ্যতে সেরকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

কিন্তু তারপরেই তিনি রাকায় তার পারিবারিক জীবনের একটা বর্ণনা দেন। এই বিবরণে তিনি দাবী করেন, তার সংসার জীবন ছিল অন্তরীণ – কিন্তু ঘরের বাইরে তখন বয়ে যাচ্ছিল সন্ত্রাসের ভয়াবহ এক ঝড়।

তিনি বলেন, এই দুটো জীবনকে তিনি আলাদা করে ফেলেছিলেন। বাইরে কী হচ্ছে এবং আই এসের অপরাধী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তার স্ত্রী শামীমা কিছুই জানতেন না।

অবশ্য এ ব্যাপারে শামীমা বেগম নিজে ভিন্ন কথা বলেছেন। তিনি বলেছিলেন, বোমা ও বিস্ফোরণের শব্দ পেতেন তিনি। রাস্তায় কাটা মাথা পড়ে থাকতেও তিনি দেখছেন এবং এসব তাকে কখনো বিচলিত করেনি।

শামীমা বেগমের স্বামী ইয়াগো রিয়েডিক বলেন, “আমি তাকে সুরক্ষিত একটি আবরণের ভেতরে রেখেছিলাম। বাইরে কী হচ্ছে সে বিষয়ে আমি তাকে কোন তথ্যই দিতাম না। সমস্যা বা বিপদ য কিছু আসতো সেগুলো আমিই সামাল দিয়েছি।”

“সে ঘরেই থাকতো এবং আমি যখন বাইরে থাকতাম সে ঘর সংসার সামলাতো।”

তিনি বলেন, “আমার কাজ ছিল তাকে খাওয়ানো, নিজের খাওয়া জোগাড় করা, সিদ্ধান্ত নেওয়া, সমস্যা থেকে দূরে থাকা এবং গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর হাত থেকে নিজেদের জীবন রক্ষা করে নিরাপদে থাকা।”

সাংবাদিক কোয়েন্টিন সামারভিল লিখেছেন, তিনি যখন শামীমা বেগমের সাথে কথা বলতে গিয়েছিলেন তখন শামীমা তাকে বলেছিলেন যে এক সুন্দর জীবনের আশায় তিনি আই এসে যোগ দিয়েছিলেন।

শামীমা বেগম তাকে বলেছিলেন, “যুক্তরাজ্যে বিয়ের ব্যাপারে আমার পরিবার আমাকে সাহায্য করতো না। কিন্তু তারা আমাকে দেখিয়েছিল ইসলামিক স্টেটে সংসার জীবন কতো সুন্দর হতে পারে।”

“পরিবার ঠিক যেমন নিখুঁত হওয়া উচিৎ সেরকম। তারা আমার ও আমার পরিবারের দেখাশোনা করবে। এবং এটাই সত্য ছিল।”

“শুরুতে তারা আমার ও আমার পরিবারের যত্ন নিয়েছিল। কিন্তু তারপরে সবকিছু বদলে যেতে শুরু করে। তারা যাদেরকে হত্যা করেছিল তাদেরকে আমি দেখেছি। কিন্তু কীভাবে হত্যা করা হয়েছে সেটা আমি দেখিনি।”

মি. রিয়েডিকের কাছে পৃথিবীটা ছিল মুন্ডুহীন মৃতদেহের এক পৃথিবী। আর ছিল আই এসের কারাগার এবং নির্যাতন।

শামীমা বেগমও বলেছেন যে তিনি একটি ডাস্টবিনে মানুষের কাটা মাথা পড়ে থাকতে দেখেছিলেন। তার স্বামী ইয়াগো রিয়েডিক বলেছেন, ওই মাথাটা ছিল একটা ব্যাগের ভেতরে। আর ওই ব্যাগটা রাখা ছিল একগাদা নিহত বন্দীর লাশের উপরে। তাদের পরনে ছিল সামরিক পোশাক।

তিনি বলেন, ব্যভিচারের অভিযোগে অভিযুক্ত এক নারীকে পাথর মারার এক ঘটনায় তিনি উপস্থিত ছিলেন।

তিনি জানান, সেসময় ওই নারীর মৃত্যু হয়নি। তিনি উঠি দাঁড়িয়েছিলেন এবং দৌড়ে চলে গেছেন।

“দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলার মতো কিছু আমি দেখিনি। তবে এধরনের শাস্তির কথা আমি শুনেছি।”

শামীমা বেগম বলেছেন, তার স্বামী আসলে কোন যোদ্ধা ছিলেন না। তবে মি. রিয়েডিক আই এসের হয়ে যুদ্ধ করতে কোবানিতে গিয়েছিলেন এবং যুদ্ধে তিনি আহত হয়েছিলেন।

তার পরে তিনি আলেপ্পোতেও যুদ্ধ করেছেন।

মি. রিয়েডিক এখন বলছেন, “আমি খুব বড় একটা ভুল করেছি। আমার জীবন থেকে কয়েক বছর নষ্ট হয়ে গেছে। এটা ঠিক আমার জীবন ছিল না।”

“সৌভাগ্যবশত আমি সরাসরি কারো ক্ষতি করিনি। তবে আমি যে গ্রুপটিকে সমর্থন করে তাতে যোগদান করেছি সেটা গ্রহণযোগ্য নয়।

তিনি এও দাবি করেছেন যে তিনি অস্ত্রশস্ত্রও ব্যবহার করেন নি।

তিনি বলছেন, এখন তিনি তার স্ত্রী শামীমা ও নবজাতক পুত্রকে নিয়ে নেদারল্যান্ডসে ফিরে যেতে চান।

“আমি বুঝতে পারি, আমি যেটা করেছি সেটা নিয়ে অনেকেরই আপত্তি আছে। আমি যা করেছি সেটার দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে। আমি আমার সাজা খাটবো। কিন্তু আমি আশা করছি যে একটি সংসার করার জন্যে আমি আমার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবো।”

কিন্তু শামীমা বেগম এবং ইয়াগো রিয়েডিক তাদের কারো কাছেই পাসপোর্ট নেই। নেই তাদের ভবিষ্যতের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণও।

শামীমা বেগম নারীদের যে ক্যাম্পে আছেন তার স্বামীর জেলখানা থেকে সেটা খুব একটা দূরে নয়। তবে তাদের একসাথে হওয়ার সম্ভাবনাও এই মুহূর্তে চোখে পড়ছে না।