সিলেটে করালগ্রাসী বন্যার ক্ষয়ক্ষতিতে বানভাসি মানুষের অন্তহীন দুর্ভোগ

সিলেট জুড়ে প্রলয়ষ্করী বন্যার ক্ষয় ক্ষতিতে মানুষের মাঝে বোবা কান্না দেখা দিয়েছে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে করালগ্রাসী বন্যার ক্ষয় ক্ষতিতে বানভাসি মানুষের অন্তহীন দুর্ভোগের চিত্রও ফুটে উঠেছে। পানির তোড়ে ভেসে গেছে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, ঘরে রক্ষিত বছরের খোরাকী ধান-চাল, শিক্ষায়তন, অবোধ প্রাণী।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এবারের বন্যা ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালের বন্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। সিলেট-সুনামগঞ্জ এলাকায় পানির উচ্চতা ১৯৮৮, ১৯৯৮ কিংবা ২০০৪ সালের চেয়ে বন্যার পানির উচ্চতায় নতুন রেকর্ড করেছে। ১৯৮৮ সালে সিলেটের ৬১% ও ১৯৯৮ সালে ৬৮% এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। কিন্তু এবার সিলেট জেলার ৮০ ও সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশের বেশী তলিয়ে যায় পানিতে। বন্যায় মেরুদন্ডে আঘাত হেনেছে প্রায় ৫০ লাখ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, দিনমজুর ও কৃষকের।

বন্যাকবলিত এলাকার ১৪২ কোটি টাকার মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন প্রায় ৩৩ হাজার খামারী। পুকুর ও মাছের ঘের থেকে ২ থেকে ৩ লাখ টন মাছ বেরিয়ে গেছে।
বন্যায় গৃহপালিত পশু-পাখি নিয়ে দুর্যোগ কবলিত মানুষ ও খামারীরা মহাবিপদে পড়েছেন। পশু-পাখির খাদ্য ও থাকার জায়গার অভাবে পানির দামে বিক্রি হচ্ছে গবাদী পশু-পাখি। তাদের পাশেও দাঁড়াতে হবে সরকারকে। বন্যার ভেসে গেছে ১ লাখ হেক্টরেরও বেশী ফসলী জমি। ক্ষতিগ্রস্ত এসব কৃষকের পাশেও দাঁড়াতে হবে।

পানির তোড়ে ভেসে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে হাজার হাজার ঘর-বাড়ী। এসব ক্ষতিগ্রস্তদের পুণর্বাসিত না করলে মানবিক বিপর্যয় ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

গতকাল শনিবার (২৫ জুন) কোম্পানীগঞ্জের এক নারী বানভাসী চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন, বন্যায় সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এখন পানি নেমে গেলেও বসবাস করার একমাত্র ভরসা হবে রাস্তাঘাট। ঘরবাড়ি মেরামত সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে বলেন, ছেলে মেয়েদের যেখানে খাবার দিতে পারবো কিনা তা জানি না, বসতবাড়ি করা তো এখন দুঃস্বপ্ন। তার উপর রয়েছে ঋণের বোঝা। সরকার আমাদের ত্রাণের পাশাপাশি পুনর্বাসন না করলে মৃত্যু ছাড়া আর কোন পথ দেখছি না।’ শুধু ওই মহিলা নয়, একই সুর ও অভিন্ন বক্তব্য সিলেটের প্রায় সব বানভাসীরই।

১৫ জুন থেকে একে একে প্লাবিত হয়েছে গ্রামীণ জনপদ, সড়ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার ও নগর। ভারত থেকে প্রবাহিত নদনদীর প্রবাহ ও মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি ও সিলেটে অতি ভারী বৃষ্টির কারণে এ অঞ্চলে বন্যার ভয়াল রূপ। বন্যায় ৫০ লাখ মানুষ পানিবন্দী। বহু মানুষ পানিতে ভেসে গেছে। এখন পর্যন্ত ৫১ জনের প্রাণহানির হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার থেকে বিভিন্ন নদীর পানি ধীরগতিতে কমছে। তবে সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সে এলাকায় পানি কমে ১৩ দশমিক ৭০ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদীর সিলেট পয়েন্টে বৃহস্পতিবারের তুলনায় শূন্য দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ কমে রোববার পর্যন্ত১০ দশমিক ৯০ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ পয়েন্টে বৃহস্পতিবার থেকে এখন পর্যন্ত ১৭ দশমিক ২৮ সেন্টিমিটারে রয়েছে। শুক্রবার ওই পয়েন্টে ছিলো ১৭ দশমিক ২৪, যা বিপদসীমার উপরে। কুশিয়ারা নদীর শেওলা পয়েন্টে পানি শনিবারের তুলনায় শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ বেড়ে ১৩ দশমিক ৭১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

স্থানীয় সূত্র বলছে, সুনামগঞ্জে, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারে গত ৩/৪ দিন ধরে বৃষ্টি পাত না হওয়াতে বন্যার পানি তেমন কমছে না স্থির হয়ে পড়েছে। তবে প্রতিদিন কোন কোন দিন কংবা হাওর থেকে বৃদ্ধ, তরুণ, পুরুষ, মহিলা ও মিশু লাশ উদ্ধার করছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। এগুলো বেশিব ভাগ মানুষ বন্যার পানিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করছেন। তাছাড়া ভেসে যেতে দেখা গবাদী পশু, গরু, ছাগল, হাস, মুরগি।
এদিকে, সিলেটে বন্যায় শনিবার আরো ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে সিলেটে মৃত্যু বেড়ে ৫১-এ পৌঁছেছে। এর মধ্যে সিলেট জেলার ১৬ জন, সুনামগঞ্জের ২৬ জন, হবিগঞ্জের ২ জন, মৌলভীবাজারের ২ জন।