সেতুর ওপর বসতঘর!

দেখে অবাক হতে পারেন যে কেউ! কিন্তু ঘটনা তাই। চলাচলের জন্য নিমার্ণ করা সেতুতে করা হয়েছে ঘর! আর পথচারী মানুষজন যাচ্ছে সেতুর নীচ দিয়ে হেঁটে। এমন একটি সেতুতে তিন বছর ধরে ঘর তৈরি করে বসবাস করছেন স্থানীয় জলমহালের লোকজন।

নেত্রকোণার খালিয়াজুরী হাওরাঞ্চলের চাকুয়া ইউনিয়নের ফরিদপুর গ্রামের এমন ঘর তৈরি করা হয়েছে।

সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছিল বছর ছয় আগে। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে সেতু নির্মাণ করা হয়েছে তা আর সফল হয়নি। নির্মাণের পর থেকে সেতু দিয়ে আজ পর্যন্ত কোন যানবহন চলাচল করেনি, এমনকি হেঁটে পার হতে পারেনি কেউ। কারণ, সেতুর দু’পাশে সংযোগ সড়ক নেই। এজন্য সেতুর ওপরে ঘর বেঁধে তা কাজে লাগানো হচ্ছে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লেপসিয়া বাজার থেকে ফরিদপুর হয়ে জগন্নাথপুর পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার মাটির ডুবো সড়ক রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ওই সড়ক দিয়ে শুকনা মৌসুমে প্রতিদিন লেপসিয়া, ফতুয়া, ফরিদপুর, রাশিদপুর, চাকুয়া, জগন্নাথপুরসহ আশপাশের অন্তত ১২টি গ্রামের প্রায় আট হাজার মানুষ চলাচল করে।

গত ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে সড়কের ফরিদপুর এলাকায় জলমহালসংলগ্ন খালের ওপর একটি উঁচু পাকা সেতু নির্মাণ করা হয়। ৩৮ ফুট দৈর্ঘ্যের সেতুটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৩০ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। হাবিব এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি বাস্তবায়ন করে। কিন্তু সেতুর দুপাশে সংযোগ সড়ক না থাকায় নির্মাণের পর থেকে সেতুটির ওপর দিয়ে মানুষ ও যানবাহন চলাচলে কোন কাজে আসেনি।

গত চার বছর ধরে সেতুর ওপর দুই তৃতীয়াংশ জুড়ে একটি টিনের ঘর তৈরি করে তা ব্যবহার করা হচ্ছে। ফরিদপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে ইজারা নেওয়া জলমহালের লোকজন ওই ঘরটি তৈরি করে ব্যবহার করছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে সেতুর ওপর ঘরটির চৌকিতে বসে জলমহালের লোকজন গল্প করছেন। এক পাশে অনেকগুলো ধানের বস্তা রাখা আছে। ঘরের সামনে হাওরের বোরো ধান কাটার বেশ কয়েকজন শ্রমিক বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। আর সেতুর পূর্ব পাশে নিচ দিয়ে বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল, ঘোড়ার গাড়িসহ পথচারীরা হেঁটে যাচ্ছেন।

তাদের মধ্যে ফতুয়া গ্রামের মো. জালাল উদ্দিন, আবুল কাশেম, ফরিদপুরের হানু মিয়া বলেন, ছয় বছর আগে সেতু হল, সড়ক হল কিন্তু এলাকার মানুষ এর সুফল পাচ্ছে না। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য রেবেকা মমিন ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সেতুটি বরাদ্দ দেন। সেতুর দুই পাশে মাটি না থাকায় এটি অচল। এজন্য তিন বছর ধরে সেতুর ওপর ঘর করে লোকজন বসবাস করে।

ফরিদপুর গ্রামের বাসিন্দা মাদ্রাসা ছাত্র তরিকুল মিয়া বলেন, ‘সেতুটি নির্মাণের পর থেকে মানুষ চলাচলের কাজে না আসলেও ঘর বেঁধে জলমহালের লোকজন বসবাস করে পাহারার কাজে তো আসছে। এ দৃশ্য বাংলাদেশের আর কোথাও নাই! ‘সরকারের লাখ লাখ টাকা খরচ করে সেতুটি কোন কাজে আসছে না। তিনি সংযোগ সড়কসহ মাটির সড়কটি উঁচুসহ পাকা করার দাবি জানান।’

উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও চাকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ওই সেতুটির ওপর প্রায় চার বছর ধরে জলমহালের লোকজন ঘর বেঁধে মাছ পাহাড়া দিচ্ছে। সংযোগ সড়কের জন্য বেশ কয়েকবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না।

তিনি জানান, সেতুর দুপাশে সংযোগ সড়ক হলে ওই রাস্তা দিয়ে ইজিবাইক, সিএনজিসজ ছোট যানবাহন সহজেই চলাচল করতে পারবে। মানুষের কষ্ট লাঘব হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফরিদপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আবু সিদ্দিক ও সদস্য মাঈন উদ্দিন বলেন, ‘সেতুটি বানানোর পর থেকে অকেজো হিসেবে পড়ে থাকায় আমরা কয়েক বছর আগে ঘর বানিয়ে পাহারার কাজে লাগাচ্ছি। যদি দুই পাশে মাটি ফেলে সংযোগ সড়ক বানায় তবে সঙ্গে সঙ্গে ঘরটি ভেঙে নিয়ে যাব।’

খালিয়াজুরী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রাজিব আহমেদ বলেন, ‘কিছু দিনের মধ্যেই হাওরে পানি চলে আসবে। তখন ওই রাস্তাটিও ডুবে যাবে। আগামী শুকনা মৌসুমে সেতুর দুপাশে সংযোগ সড়ক তৈরি করার পরিকল্পনা আছে। বর্তমানে সেতু নিচে দিয়ে বাইপাস সড়ক আছে। পথচারীসহ ছোট যানবাহন চলাচল করতে সমস্যা হচ্ছে না।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এইচএম আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক কাজি মো. আবদুর রহমান বলেন, বিষয়টি নজরে এসেছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সাথে কথা বলে ঘরটি সরানোর ব্যবস্থা করে এপ্রোচ সড়ক নির্মাণ করে এলাকাবাসীর সমস্যা সমাধান করা হবে।