স্বাধীনতার অর্ধশত বছরেও মুরাদনগরে পালন হয়নি হানাদার মুক্ত দিবস

স্বাধীনতার ৪৬ বছর অতিবাহিত হলেও কখনো পালিত হয়নি কুমিল্লার মুরাদনগর মুক্ত দিবস। মুরাদনগর মুক্ত দিবসটি কবে তা জানেনা স্থানীয় জনগণ, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল কিংবা স্থানীয় প্রশাসনও। মুক্ত দিবসের দিন-তারিখ নিয়েও রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে নানা বিতর্ক। তবে মুক্তিযোদ্ধের চেতনয় বিশ^াসাশিরা বিজয়ের এ মাসে জানতে চায় মুরাদনগর মুক্ত দিবস কবে এবং তা’ কবে পালিত হবে।

মুরাদনগর মুক্ত দিবসের দিন-তারিখ নির্ধারন নিয়ে বিতর্কের বিষয়টি সর্বসাধারনকে ভাবিয়ে তুলেছে। মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি সংরক্ষন পরিষদ ও সকল পেশাজীবী লোকজন সঠিক ইতিহাস থেকে তথ্য জেনে মুক্ত দিবসের দিন-তারিখ নির্ধারণ করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন। এছাড়াও তারা প্রতিবছর ঝাঁকঝমকপূর্ন ভাবে মুরাদনগর মুক্ত দিবস উদযাপন করারও দাবি জানিয়েছেন।

তবে জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঐকমত্যে পৌছেছেন যে, ১৯৭১ সালে তৎকালীন কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানা হানাদার মুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর। সে হিসেবে ৬ ডিসেম্বর সোমবার মুরাদনগর হানাদার মুক্ত দিবস। কিন্তু গত ৫০ বছরে পালন করা হয়নি গৌরবের এ দিনটি। এমনকি এবার মহান স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরেও পাকিস্তানি দখলদারদের হটিয়ে স্থানীয় কতিপয় বীর মুক্তিযোদ্ধার বাংলাদেশের পতাকা উড়ানোর দিনটি পালনে কোন উদ্যোগ-আয়োজন নেই। পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে মুরাদনগরবাসীর বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের স্মারক দিবস নীরবে অতিবাহিত হয় বলে জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তক্ষরণ হচ্ছে!

দীর্ঘ পাঁচ দশকে মুরাদনগরের মুক্ত দিবস নিয়েও বিভ্রান্তি বা বিতর্ক ছিল। এ বিভ্রান্তি বা বিতর্ক অবসানে কেউ এগিয়ে এসেছেন- এমন তথ্য জানা যায়নি। বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি অনুযায়ী মুরাদনগরেও তা পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে শুধুই মুরাদনগরের মহান বিজয় দিবস তথা শত্রুমুক্ত দিবস পালনের বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা ভেবেছেন বলে মনে হচ্ছে না। যেন ‘কূম্ভকর্ণের ঘুম’ ঘুমাচ্ছেন তারা। তবে স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা মুরাদনগর মুক্ত দিবসকে দেশের অন্যান্য জনপদের মতো উদযাপন করতে চান, নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সার্বিক ও স্থানীয় ইতিহাস জানাতে চান সেটা আলাপচারিতায় বোঝা গেল।

মুক্তিযুদ্ধকালীন মুরাদনগর থানার সহকারী কমান্ডার গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ বলেন, মুরাদনগর হানাদার মুক্ত দিবস পালন করা সময়ের দাবি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অংশ। কিন্তু সে কাজটি করবে কে? চাপা ক্ষোভ ও কষ্ট কিছুটা উগড়ে বললেন, “উপজেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা এ কাজে এগিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু তারা আসেন না। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা তো চাইলেই একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারি না। একটা আয়োজনের সাথে আর্থিক সংশ্লেষ আছে। সে ব্যয়টা কে করবে? এমপি সাহেব (বর্তমানে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন) এদিকে নজর দিলে অবশ্যই তা হতে পারে।

উপজেলার পীরকাশিমপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আর্মি তাহের মুরাদনগরের আলোচিত চাপিতলা সম্মুখ যুদ্ধ সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে বলেন, তাঁর তথ্য অনুযায়ী, “১৯৭১ সালের ৩১ অক্টোবর (মোতাবেক ৩ কার্তিক, ১০ রমযান) ভোরে পাকিস্তানিরা বৃষ্টিপুর, গাজীপুর থেকে চাপিতলা ও খামারগ্রাম এলাকায় হামলা চালায়। এতে স্থানীয় তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পাকিস্তানি সেনারা এলাকা ছাড়ে।”
বাখরনগর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস মুহুরী জানান, “সশস্ত্র পাকিস্তানিদের সাথে মুক্তিকামী স্থানীয়দের অসম লড়াই পুষ্কুরনীপাড়ের রমিজউদ্দিন, কদমতলীর বাচ্চু মিয়া এবং বলিঘরের আবুল বাশার শহীদ হন। নিজ বাড়ি বাখরনগর থেকে নানা কৌশলে টনকি গিয়ে হানিফ চেয়ারম্যানের বাড়ির পশ্চিমপাশে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেই। এক পর্যায়ে অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তানিরা পিছু হটে। এ সময় পাকিস্তানিদের এলোপাতাড়ি গুলিতে চাপিতলা গ্রামের জনৈক কাশেম মারা যান।

মুরাদনগর কবে হানাদার মুক্ত হয়? তিনি বললেন, “বয়স হইছে। এখন তো অনেক কিছুই মনে নাই। কুমিল্লা মুক্ত হইছে ৮ ডিসেম্বর। আমাদেরটা (মুরাদনগরের) ঠিক জানি না। তবে এই সময়ই হবে। পাশের থানা দেবীদ্বার দখলদার মুক্ত হইছে ৪ ডিসেম্বর।” বীর মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস উদ্দিন মাহমুদের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের পতাকা উড়ানোর প্রসঙ্গটি তাঁকে অবহিত করলে বাখরনগর গ্রামের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় কামরুল হাসান ভূঁইয়া থানা কমান্ডার ছিলেন আর সহকারী কমান্ডার ছিলেন গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ। কামরুল হাসান মারা গেছেন। গিয়াস উদ্দিন যেহেতু ৬ ডিসেম্বর পতাকা উড়িয়েছেন সেদিনটাকেই মুরাদনগরের হানাদার মুক্ত দিবস ধরা যায়। দক্ষিণ মুরাদনগর এলাকায় পতাকা উড়ানোর কোন ঘটনা আমার মনে পড়ছে না।”

অবশ্য মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক ও গণপরিষদের সাবেক সদস্য হাজি আবুল হাশেম তার জীবদ্দশায় একটি জাতীয় দৈনিকের সাথে আলাপকালে জানিয়েছিলেন, “১২ ডিসেম্বর মুরাদনগরে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী মুক্ত হবার খবর পেয়ে ভারতের আগরতলা থেকে সাড়ে ৪শ’ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কোম্পানীগঞ্জ হাইস্কুলে প্রবেশ করে উড়িয়ে দেয়া হয় স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজের পতাকা। তখন মুরাদনগরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন কামরুল হাসান ও গিয়াস উদ্দিন।”

এ বিষয়ে মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অভিষেক দাশ বললেন, “পার্শ্ববর্তী দেবীদ্বারের মুক্ত দিবস ছিল ৪ ডিসেম্বর। এটা পত্রিকায় দেখার পর মনে হচ্ছিল মুরাদনগরে কেন মুক্ত দিবস নেই বা পালন করা হয় না। আপনাদের মাধ্যমে (সাংবাদিক) ৬ ডিসেম্বর মুরাদনগর মুক্ত দিবস জানার পর আমি আরও তাগিদ বোধ করছি। মুক্তিযোদ্ধাদের ডেকে সীমিত পরিসরে হলেও কিছু একটা আয়োজনের চেষ্টা করবো।”