লকাডাউনেও

স্বাস্থ্যঝুঁকিতে দু’লাখ মানুষ তবু আয়োজন চট্টগ্রামের মইজ্জ্যারটেক পশু হাট

চট্টগ্রামসহ সারাদেশে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। মহামারি করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ভয়াবহ সংক্রমণের মুখে পুরোদেশ। এমন লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যেও চট্টগ্রাম শহরের প্রবেশমুখ কর্ণফুলীতে ‘মইজ্জ্যারটেক পশুরহাট’ বসানোর ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা নিয়ে আয়োজক পক্ষ এখনও কোন কিছু স্পষ্ট না করায় সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

অন্যদিকে, লকডাউনে গরুর হাট বসবে কিনা এ বিষয়ে সরকারের স্পষ্ট কোন নির্দেশনা জারি করা হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায়।

ইজারাদার পক্ষের লোকজন জানায়, ‘তাঁরা হাটের সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে। তবে করোনা মহামারি পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে যদি হাট বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়, তবে বন্ধ হবে হাট।’

স্থানীয়রা জানান, ‘লকডাউনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য প্রশাসনের প্রচার-প্রচারণা ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত থাকলেও কর্ণফুলীর বাজারগুলোর ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে সচেতনতা নেই। অভিযানের কথা শুনলেই মাস্ক পরাসহ অন্য বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেন লোকজন। পরে প্রশাসনের লোকজন চলে গেলে আগের অবস্থায় ফিরে যান তারা। সঠিকভাবে কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না।’

পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ছোট্ট উপজেলা কর্ণফুলী। শহরের প্রবেশমুখ ও মহাসড়কের পাশে মইজ্জ্যারটেকে বসছে পশুর হাট। পাঁচ ইউনিয়নে ৪টি পশুর হাট (মইজ্জারটেক, ফাজিলখাঁর হাট, ফকিরনিরহাট, কলেজবাজার) বসা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

এসব পশুরহাট গুলো জনসাধারণের জন্য বিষপোড়া ও কর্ণফুলী করোনার হটস্পটে পরিণত হবে না তো!

মইজ্জ্যারটেক বড় পশুর হাটে বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে কুরবানির পশু কেনাবেচা করতে আসবে ক্রেতা-বিক্রেতারা। এক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানা হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। কেননা, কেনাবেচা করতে মাঠে আসবে হাজার হাজার মানুষ। প্রায় ২৫ হাজার পশু ধারণ ক্ষমতার এ হাটে এক পশুর পেছনে দুজন করে লোক থাকলেও অর্ধলক্ষ লোক।

পাশাপাশি ক্রেতার উপস্থিতি মিলে এতো মানুষের উপস্থিতি করোনা ঝুঁকিতে ফেলতে পুরো উপজেলার দু’লক্ষাধিক সাধারণ মানুষকে।

বিষয়টি জেলা প্রশাসনের ভেবে দেখা প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

স্থানীয় পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ‘কঠোর বিধি-নিষেধের প্রজ্ঞাপনে পশুর হাট নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। এমনকি জেলা প্রশাসন থেকেও কোন নির্দেশনা পাননি। ফলে, অন্যান্য বাজারের মতো পশুর হাট শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।’

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, মইজ্জ্যারটেকস্থ সিডিএ আবাসিকের ভেতর হাট বসানোর প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশেই এই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। হাসিলের অর্থ আদায়ের জন্য অস্থায়ী কাউন্টার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যবেক্ষণের জন্য ওয়াচ টাওয়ারসহ কন্ট্রোল রুম। পশুর হাটের বেশ কয়েকটি স্থানে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আলোকসজ্জাসহ মইজ্জ্যারটেক পশুর হাটের প্রস্তুতি নিয়ে ডেকোরেটর কর্মীরা এখন কর্মব্যস্ত সময় পার করছেন।

যদিও করোনাকালে পশু কোরবানি নিয়ে মিশ্র ভাবনায় পড়েছেন সাধারণ মানুষেরা।

গরু বেপারিরাও ঝুলন্ত অবস্থায়। অনেক জায়গায় কোরবানির পশুর হাট পরিচালনাকারীরা দোদুল্যতায় হাবুডুবু খাচ্ছে। বেপারি ও হাট কর্তৃপক্ষ তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে।

চট্টগ্রামের ৬টি উপজেলায় যে হারে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে তাতে হাট না বসানোর নির্দেশও আসতে পারে।

জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের (১ থেকে ৮ জুলাই) ৮ দিনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, উপজেলাগুলোতে মোট শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ২৪৪ জন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ৭ উপজেলায় শনাক্ত হয়েছে ২৬৭ জন। সংক্রমণের হার ২১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ছড়িয়েছে পটিয়ায় ৪৭ জন। পটিয়া কর্ণফুলীর পাশাপাশি একটি উপজেলা।

চট্টগ্রাম জনস্বাস্থ্য রক্ষা কমিটি সদস্য সচিব ডা. সুুশান্ত বড়ুয়া বলেন, ‘দক্ষিণ চট্টগ্রামে করোনা পরীক্ষা ততটা সহজলভ্য নয়। এজন্য হয়তো কম পরিলক্ষিত হচ্ছে।’

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আবদুর রব মাসুম বলেন, ‘হাসপাতালে যেসব রোগী আসছে এর মধ্যে নগরের পাশাপাশি উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণ উপজেলা এলাকার রোগী রয়েছে। করোনা সংক্রমণ যে উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।’

সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘উপজেলা সমূহের জনগণ সাধারণত করোনা নিয়ে সচেতন নন। জ্বর-সর্দি-কাশি হলে চিকিৎসকের কাছে আসতে চান না। তাই এসব এলাকায় সংক্রমণের হার বাড়ছে। আর কোরবানির পশুরহাটে হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে স্বাস্থ্যবিধি মানা অসম্ভব।’

এদিকে, কোরবানির ঈদের বাকি মাত্র দিন দশেক। এই সময়ে মানুষ ও গরুর (কোরবানির) হাটে হাটে ঘোরার কথা। কোভিডের ভয়ে মানুষ ঘরে আর গরু খামারে বন্দী। এর মধ্যেই খামারিরা গরুগুলোকে তরতাজা করা নিয়ে ব্যস্ত। সাধারণ মানুষ পশু কোরবানি নিয়ে স্বজনদের সঙ্গে বৈঠক করছে এক সঙ্গে বসে।

হাটে কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।

মইজ্জ্যারটেক পশু হাটের পশু সাধারণত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসে। দেশজুড়ে করোনা সংক্রমণের মধ্যে এসব হাটে বিক্রেতা ও ক্রেতার স্বাস্থ্যবিধি কীভাবে নিশ্চিত হবে, সেটি এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. সেলিম সরোয়ার বলেন, ‘সামনে করোনা পরিস্থিতি কেমন যাবে, তার ওপর নির্ভর করছে পশুর হাট। যদি সংক্রমণ বাড়ার ধারাবাহিকতা থাকে, তাহলে হাটের বিকল্প চিন্তা করতে হবে। আর যদি হাট বসাতেই হয়, তবে শহরের প্রবেশমুখে কিংবা জনবহুল এলাকায় বাজার বসানো উচিত হবে না। হাট বসানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে।’

মইজ্জ্যারটেক পশুর হাটের ইজারাদার জামশেদ খাঁন বলেন, ‘বৈশাখের ১ তারিখ থেকে আগামী বছরের চৈত্র মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত প্রায় ২ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ইজারা নিয়েছি। আর স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি আপনারা বাজার চলাকালিন সময় সরাসরি আসলে দেখতে পাবেন।’

তথ্য দিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসনের সাথে ইজারাদারদের বৈঠক হয়েছে। সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন উপজেলা প্রশাসন। এবারে প্রতি হাজারে ৪০ টাকা করে হাসিল নেওয়া হবে।’

লকডাউনে করোনার ঝুঁকি নিয়ে কেন হাট বসানো হচ্ছে জানতে চাইলে কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী বলেন, ‘আজকে সিনিয়র সচিবসহ ভার্চুয়াল জুম মিটিং হয়েছে। মানুষ এখনো অনলাইনে অভ্যস্ত না হওয়ায় সীমিত পরিসরে পশুরহাট বসানোর অনুমতির কথা বলা হয়েছে। কর্ণফুলীতে চারটি পশুর হাটের অনুমতি দেয়া হয়েছে। আপনি যে স্বাস্থ্যবিধির কথা জানতে চাইলেন? শুধু পশুরহাটে কেন? বাস্তবতা হলো-করোনা ভীতি কিংবা স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে মানুষের বিন্দুমাত্র এলার্জি নেই।’

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)’র মাঠে পশুর হাট বসানো ও জেলা প্রশাসন থেকে হাটের অনুমোদন বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শাহিনা সুলতানা বলেন, ‘পশুর হাটের জন্য সিডিএ’র যে জায়গা ব্যবহার করা হচ্ছে তার অনুমোদন আছে আমাদের। আর যেগুলো আমরা হাটবাজার ইজারা দিয়েছি ওখানেই বলা ছিলো যে, আমরা গরুর বাজার করব। এক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের অনুমতির প্রয়োজন নেই। স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি হলেই হয়।’

অন্যদিকে, এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত চসিক ছাড়া নগরের কোন জায়গায় কোনো ধরনের কোরবানির পশুর হাটের অনুমতি দেয়নি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক।