বদলে যাওয়া তামিমের গল্প
২০০৭ সালের বিশ্বকাপের ঠিক পরের কথা। তখনো তার টেস্ট অভিষেক হয়নি। টাইগারদের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়া ভারত বাংলাদেশে এসেছিল পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে। একদিনের ক্রিকেটে তামিম ইকবালের ঝড়ো ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ ভারতীয় সিনিয়র ক্রিকেট সাংবাদিক ও নামী লিখিয়ে এবং কলকাতার বিখ্যাত বাংলা দৈনিক আজকালের ক্রীড়া সম্পাদক দেবাশীষ দত্ত।জাগো নিউজের সৌজন্যে প্রকাশিত।
শেরে বাংলার প্রেস বক্সেও এক আড্ডায় ওই বরেণ্য ক্রিকেট লেখিয়ের বলে উঠলেন, ‘আরে তোমরা যে কি করো বুঝি না! তামিম তো বাংলাদেশের বিরেন্দর শেবাগ। ছেলেটার মধ্যে বারুদ আছে। দেখ না যাকে যেখান দিয়ে খুশি মুড়ি-মুড়কির মত উড়িয়ে মারছে। তাকে শুধু ওয়ানডে কেন, সব ফরম্যাটেই ব্যবহার করা উচিত। তার খুনে মানসিকতা আর আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করার প্রবল ইচ্ছে এবং সহজাত ও স্বভাবসুলভ ফ্রি স্ট্রোক খেলার সামর্থ্য হতে পারে যে কোন দলের সম্পদ। প্রতিপক্ষ বোলিং লন্ডভন্ড হয়ে যায় ওর (তামিমের) মারের তোড়ে।’
আজকালের ক্রীড়া সম্পাদক দেবাশীষ দত্ত একটুও বাড়িয়ে বলেননি। সত্যি তামিম ক্যরিয়ারের শুরু থেকে বেশ অনেকটা সময় ছিলেন অশান্ত। ওয়ানডে হলে তো কথাই নেই। এমনকি টেস্টেও তামিম ইকবাল মানেই উত্তাল উইলোবাজি। তামিম যেন ‘ঝড়ের পাখি।’ উইকেটে গিয়ে যাকে তাকে যেখান খুশি সেখান দিয়ে উড়িয়ে মারা, চার ও ছক্কার ফুলঝুড়ি ছোটানো আর প্রতিপক্ষ বোলিংকে তছনছ করে দেয়াই ছিল তার মূল লক্ষ্য।
কিন্তু গত বিশ্বকাপের পর থেকে যত সময় গড়িয়েছে ততই কেমন যেন বদলে গেছে তার দর্শন। আর ব্যাটিং স্টাইলও অনেকটাই পাল্টে গেছে। তার মনে হয়েছে, আমার সামর্থ্য আছে লম্বা ইনিংস খেলার। আমি মারতে পারি। শটস খেলায় কোনই ঘাটতি নেই। উইকেটে যত বেশি সময় থাকবো, যত বেশি বল খেলবো, তত রান করে দীর্ঘ ইনিংস সাজানোর সুযোগ বেশি পাবো।
তাহলে উইকেটে গিয়েই অত বেশি চার ছক্কার ফুলঝুড়ি ছোটানোর দরকার কি? অযথা তড়িঘড়ি করে আর প্রতিপক্ষ বোলিংয়ের ওপর বেশি চড়াও হতে গিয়ে সম্ভাবনাময় ইনিংসের অপমৃত্যু ঘটিয়েছে প্রচুর। আর না। এবার থেকে আমাকে ব্যাটিং স্টাইল পাল্টাতে হবে। ঝড়ো ব্যাটিংয়ের চেয়ে ধীরস্থির হয়ে উইকেটের চরিত্র ঠাউরে, ম্যাচ কন্ডিশন আর বলের মেধা ও গুণাগুন বিচার করে খেলবো।
বোঝাই যায়, এমন বোধোদয় থেকেই নিজেকে পাল্টে ফেলার চেষ্টা; কিন্তু কাজটা কি খুবই সহজ? মোটেই নয়। একজন ফ্রি স্ট্রোক প্লেয়ারের জন্য এ ধরনের ব্যাটিং স্টাইল পাল্টে ফেলা কিন্তু সহজ কাজ নয়।
কারণ উইকেটে গিয়ে আলগা বল পেলে তো কথাই নেই। ভাল বলকেও তাদের মারতে ইচ্ছে করে। মনে হয় খালি বাউন্ডারি হাঁকাই। কিন্তু তামিম দেখিয়ে দিলেন আসলে যে কোন কিছু করার জন্য ইচ্ছে আর চেষ্টাই সব।
তার মত একজন ফ্রি স্ট্রোক প্লেয়ারও যে রয়ে-সয়ে দায়িত্ব নিয়ে উইকেটে থেকে নিজেকে পরিবেশ, পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে লম্বা ইনিংস খেলতে পারে- তামিম তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
চট্টগ্রামের ক্রীড়া পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য ব্যাটিং স্টাইল পাল্টে যেন জানান দিলেন, যত কঠিনই হোক না কেন, মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই। চেষ্টা করলে অনেক কিছুই করা যায়। নিজেকে শুধওে নিয়ে, বদলে ফেলে অন্যরকম হয়ে যেতে পারে।
একবার মিলিয়ে দেখুন তো সেই তামিমের সাথে এই তামিম ইকবালের মিল-অমিল কতটুকু! কিছু পরিসংখ্যান দেখে নিন। এই তামিম কি সেই তামিম, যিনি ২০০৯ সালের ১৬ আগস্ট বুলাওয়েতে ১৩৮ বলে ১৫৪ রান করে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দলকে জিতিয়েছিলেন।
এরপর এই ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই তো ২০১০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী শেরে বাংলায় ১২০ বলে ১৩ বাউন্ডারি আর তিন ছক্কায় করেছিলেন ১২৫ রান! ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর ঘরের মাঠে পাকিস্তানের সাথে টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছিলেন প্রায় বল পিছু স্ট্রাইক রেটে। ২০১৫ সালের ১৭ এপ্রিল ১৩৫ বলে ১৩২ রান করেন ১৫ বাউন্ডারি ও তিন ছক্কার সাহায্যে।
দু’দিন পর ১১৬ বলে ১১৬ (১৭ বাউন্ডারি, ১ ছক্কা)। এরপর ২০১৬ সালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১১৬ বলে ১১৬। আর তারপর গত ২৫ মার্চে ডাম্বুলায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৮৯.৪৩ স্ট্রাইক রেটে ১৪২ বলে ১২৭ রান। আর আজ ক্রিকেটের অন্যতম প্রাচীন ও অভিজাত ভেন্যু কেনিংটন ওভালে ৯০.১৪ স্ট্রাইক রেটে ১৪২ বলে করলেন ১২৮ রান।
পরপর দুটি শতরানের পরতে পরতে দায়িত্ব সচেতনতা। কোনরকম তড়িঘড়ি নেই। আবেগতাড়িত কিংবা উচ্চভিলাষী শট বলতে কিছুই নেই। অপ্রেয়োজনে এর ওপর, ওর ওপর চড়াও হওয়া আর চার-ছক্কা হাঁকাতে যাওয়ার চেষ্টাই নেই।
একদম ঠাণ্ডা মাথায় শুরু। বলের মেধা ও গুণ বিচার করে রান তোলার চেয়ে শুরুতে উইকেটে থাকা ও সেট হবার চেষ্টা। তার ভালই জানা, ‘আমার যে সামর্থ্য আছে, তা দিয়ে যদি সেট হতে পারি, তাহলে লম্বা ইনিংস খেলা সম্ভব। আমি বড় ইনিংস খেললে দলের লাভ। একদিকে সাপোর্ট থাকবে। অন্য প্রান্তের ব্যাটসম্যানরা ফ্রি খেলতে পারবে। রানের চাকাও ধীরে ধীরে সচল হবে। একটা পর্যায়ে গিয়ে স্কোর লাইনও হবে বড়। এই মন্ত্রে খেলেই তামিম আজ অনবদ্য সেঞ্চুরি করলেন।
তামিম ইকবালের এমন বদলে যাওয়া রূপ দেখে অবাক অনেকেই। ভারতীয় ক্রিকেটার সঞ্জয় মাঞ্জেরেকর আর ক্যারিবীয় সাবেক ফাস্ট বোলার ইয়ান বিশপ তামিমের নিজের খোলস বদলে, জড়ো ব্যাটিং বাদ দিয়ে দায়িত্ব সচেতন হয়ে ওঠা দেখে বিস্মিত।
শুধু ঐ দুই টিভি ভাষ্যকার কেন, সেই ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ভারতীয় ফাস্ট বোলার জহির খানকে উইকেট ছেড়ে দুই তিন পা বেরিয়ে বাতাসে ভাসিয়ে বিশাল ছক্কা হাঁকানোর চিত্র এখনো মাঝে মধ্যে টিভির পর্দায় দেখা যায়।
অনেকেই আজ সেই তামিমের সাথে এই তামিমকে মেলানোর চেষ্টা করেছেন; কিন্তু মেলাতে পারছেন না। কি করে পারবেন? এই তামিম যে অনেক বেশী পরিণত। অভিজ্ঞ আর ব্যক্তিগত লক্ষ্যের চেয়ে দলের জন্য খেলেন!
সেটা যে খেলেন, আজকের ইনিংসটাই তার প্রমাণ। ২৪ নম্বর ডেলিভারিতে প্রথম বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ডাবল ফিগারে পা রাখা। ৭১ নম্বরে গিয়ে অর্ধশতকে পৌঁছানো। তখনই বুঝে নিলেন এভাবে খেললেই হয়ত তিন অংকে পৌঁছা সম্ভব।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। ৩৯ নম্বর ওভারে শতরান পূর্ণ। এরপর আবার ঝড়ের বেগে ১৮ বলে ২৮ রান (১৪২ বলে ১২৮) তুলে ৪৫ নম্বর ওভারে যখন সাজঘরে ফিরলেন তখন বাংলাদেশ পেয়ে গেছে মজবুত ভীত।
টিভির ভাষ্যকার ইয়ান বিশপ বার বার বলছিলেন, ‘তামিম ইকবালের পার্থক্যের গ্রাফটা দেখুন, ক্যারিয়ারের নয় ওয়ানডে সেঞ্চুরির পাঁচটিই গত বিশ্বকাপের পর মানে শেষ দুই বছরে।’
কেন বলুন তো? এই সময়টায় তামিম নিজেকে বদলে পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান বানিয়ে ফেলেছেন। এখন তার কাছে দল বড়। শট খেলা, চার-ছক্কা হাঁকিয়ে মাঠ গরম করা আর দর্শক বিনোদনের চেয়ে লম্বা সময় উইকেটে থাকাই বড়। তাতে শুধু যে নিজের পরিসংখ্যান সমৃদ্ধ হবে, একের পর এক লম্বা ইনিংস গড়ে উঠবে তাই নয়। দলও হবে উপকৃত।
এমন তামিমকেই তো চায় বাংলাদেশ!
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন