হেফাজত নেতাদের প্রকাশ্য হুমকি ফৌজদারি অপরাধ

সুলতানা কামালকে হেফাজত নেতাদের প্রকাশ্য হুমকিকে ফৌজদারি অপরাধ বলে মনে করছেন দেশের আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা। তারা বলছেন, এতে করে দেশে চরমপন্থার আর্বিভাব হচ্ছে। আর দেরি না করে সুলতানা কামালের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের পালন করার কথাও বলেছেন এই আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা।

সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য সরানোর বিষয়ে টকশো প্রচারিত হয়।ওই টকশোতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার জের ধরে গত শুক্রবার (২ জুন) হেফাজত নেতারা তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের আল্টিমেটাম দেন। ওই দিন সংগঠনের ঢাকা মহানগরের সহ-সভাপতি জুনায়েদ আল হাবীব বলেন, ‘‘সুলতানা কামালকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করুন। না হয় তাকে তসলিমা নাসরিনের মতো দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিন। সাহস কত সুলতানা কামালের! তিনি (সুলতানা কামাল) বলেছেন, ‘ভাস্কর্য থাকতে না দিলে মসজিদ থাকতে দেওয়া হবে না।’ সুলতানা কামাল রাজপথে নেমে দেখুন, হাড্ডি-গোস্ত রাখা হবে না।’’

অন্যদিকে গত ৪ জুন ক্ষমা না চাইলে সুলতানা কামালকে চট্টগ্রামের মাটিতে নামতে দেওয়া হবে না বলেও হুমকি দেয় সংগঠনটির চট্টগ্রাম মহানগর কমিটি।

হেফাজত ইসলামের এ ধরনের হুমকিকে ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য করেছেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘একজন নাগরিকের শারীরিক এবং মানসিক সব ধরনের সহায়তা দিতে হবে রাষ্ট্রকেই এবং এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কোনোভাবেই পিছপা হতে পারে না। এমনকি কেউ যদি প্রমাণিত অপরাধীও হয়ে থাকে, তারও পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। আর সুলতানা কামাল কোনও অপরাধই করেননি। তার পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রচারিত হওয়া টকশোতে তিনি কেবল হেফাজত নেতার কথার জবাব দিয়েছেন।’

সুলতানা কামাল কোনও অন্যায় করেননি এবং কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেন নাই মন্তব্য করে মিজানুর রহমান বলেন, ‘তার বক্তব্য বিকৃত করে প্রকাশ করছে হেফাজত-যেটা ঘোরতর অন্যায়। সুলতানা কামালের কথাকে বিকৃত করে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে দলটির পক্ষ থেকে। তারা যেসব কথা বলেছেন এবং যেভাবে হত্যার হুমকি দিয়েছেন, সেটা দেশের প্রচলিত আইনে ফৌজদারি অপরাধ। সুতরাং রাষ্ট্রকে অবশ্যই কালক্ষেপণ না করে ফৌজদারি আইনের আওতায় বিচার করতে হবে। এখানে রাষ্ট্রের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও কোনও সময় ব্যয় না করে, যে বা যারা এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন, তাদেরকে শনাক্ত করে বিচার করতে হবে।’

মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেখানে সুলতানা কামালও ব্যতিক্রম নন। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে যে অনভিপ্রেত ঘটনাগুলো ঘটছে এবং যেভাবে যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা এবং আলোচনা-বক্তব্যকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে হেফাজতের পক্ষ থেকে, তাতে তারা চরমপন্থাকে অবলম্বন করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সুলতানা কামালকে চট্টগ্রামে নামতে দেওয়া হবে না, তাকে গ্রেফতার করতে হবে-এগুলো কোনও সভ্য দেশে হতে পারে না। এগুলো সর্বাত্মকভাবে চরমপন্থার বহিঃপ্রকাশ। কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটা কোনোভাবেই সমর্থণযোগ্য না।’

হেফাজতের বক্তব্য এবং হুমকিকে বাকস্বাধীনতার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ বলে উল্লেখ করে নূর খান বলেন, ‘বাকস্বাধীনতার ওপর রাষ্ট্র যেমন হস্তক্ষেপ করতে চায়, তেমনি চরমপন্থাধারী হেফাজতের মতো সংগঠনও হস্তক্ষেপ করতে চায়। বাক স্বাধীনতাকে রাষ্ট্র এবং হেফাজত একইভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ফলে ফ্রিডম অব এক্সপ্রেসন্স এত সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে যে, একটি সভ্য সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এভাবে সামনের দিকে এগোতে পারে না।’

এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যারা এভাবে প্রকাশ্যে চরমপন্থার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন, চরমপন্থা অবলম্বন করে বক্তব্য দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং সেটা যত দ্রুত সম্ভব।’ তা নাহলে এই চরমপন্থী ধর্মীয়গোষ্ঠী সমাজ এবং রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, ‘হেফাজতের সঙ্গে কোনও সুষ্ঠু বিতর্ক সম্ভব না। তারা কোনও যৌক্তিক তর্ক মানেন না। সাধারণ নাগরিকদের এভাবে শারীরিক আক্রমণের হুমকি বিষয়ে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

‘নো ফল্টস অব মাইন, আমি আজ হুমকিতে। তার কথার পিঠে একটি প্রশ্ন আমি করেছি। কিন্তু তারা তাকে বিকৃত করে আমাকে হুমকি দিচ্ছে। মিথ্যাচার করছে। তারা পুরো জাতিকে মিস লিড করছে,’ জানিয়ে সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমার ধারণা কোনও সভ্য দেশে যদি এরকমভাবে কেউ হুমকি দেয়, তার জন্য তাকে জবাবদিহিতায় আনা হয়।’ তিনি বলেন, ‘যে ভাষায় এবং যে ভঙ্গিতে হেফাজত আমাকে হুমকি দিয়েছে সেটা অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধ। তারা হুমকি দিয়েছে প্রকাশ্যে। শুধু তাই না, তারা অন্যদেরও উস্কানি দিয়েছে। আমাকে যেভাবে একটি জায়গায় এনে তারা দাঁড় করিয়েছে, সেখানে যে কোনও জায়গায় যে কোনোভাবে আক্রমণ করতে পারে এবং তারা সেটি বলেছে।’

আমার যদি কোনও বিপদ হয় তাহলে এর দায়ভার কে নেবে প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, আমি এমন কিছুই বলিনি যে,এ ধরনের হুমকি পাবো। আমি কথার পিঠে কথা বলেছি। তাদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও ছাড় দেওয়া চলবে না। নয়তো আজ আমাকে হুমকি দিয়েছে, কাল আরেকজনকে দেবে।’