আফ্রিকার দেশ সোয়াজিল্যান্ড : যার সংবিধান লিখেছেন এক বাংলাদেশি
কানিজ ফাতেমা তিসা : ২০১১ তে বাংলাদেশ ছেড়ে সাউথ আফ্রিকার এক ছোট্ট দেশ Swaziland এ এসেছি। অনেকেই Swaziland কে Switzerland ভাবত আর আমাকে ভুল শুধরে দিয়ে বলতো আমি বানান ভুল করেছি।
একজন বাংলাদেশি হিসেবে গর্বের বিষয় হচ্ছে, এই দেশের সংবিধান লিখেছেন একজন বাংলাদেশী। বাংলাদেশের প্রখ্যাত ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম এইদেশের সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত করতে সাহায্য করেছেন। ১৯৬৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে সোয়াজিল্যান্ড।
আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত মাত্র ৪টি জেলা নিয়ে গঠিত ছোট্ট একটি দেশ সোয়াজিল্যান্ড। ২০০৯ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ১১ লাখ ৮৫ হাজার। দেশের আয়তন মোট ১৭,৩৬৪ বর্গকিলোমিটার। সোয়াজিল্যান্ডের রাজধানী এমবাবেন।
উত্তর থেকে দক্ষিণে ২০০ কিলোমিটার, পূর্ব থেকে পশ্চিম ১৩০ কিলোমিটার এই এলাকা নিয়ে সোয়াজিল্যান্ডের অবস্থান। দক্ষিণ আফ্রিকা আর মোজাম্বিকের গা ঘেঁষা এই দেশের অধিবাসীরা মূলত সোয়াজিরাই নামে পরিচিত।
সোয়াজিল্যান্ডে অনেক এশিয়ান বাস করে। প্রায় ২০০০ বাংলাদেশিসহ পাকিস্তানি, ইন্ডিয়ান সংখ্যায় অনেক এখানে। তবে বাংলাদেশি বলতে নোয়াখালীর বাসিন্দা, ইন্ডিয়ান বলতে গুজরাটি আর পাকিস্তানি বলতে পাঞ্জাবী।
প্রথম যখন সোয়াজিল্যান্ড আসি,তখন একটুও ভালো লাগেনি। মনে হচ্ছিল এ কোন গ্রামে এসেছি। কিছুদিন থেকে আবার দেশে ফিরে যাবার পরে সোয়াজিল্যান্ডকে মিস করতে শুরু করলাম। সুন্দর একটা দেশ, এখানকার অধিবাসী সবাই কালো, কিন্তু ওদের মন অনেক ভাল।এরা খুব শান্তি প্রিয় জাতি। জোরে কথা বলা এদের একটুও পছন্দ না।
বাঙালিদের তুলনায় কিন্তু এরা অনেক বোকা, মানে খুব কম বোঝে। সব ধরনের কাজের জন্য লোক পাওয়া যায়, তবে কাজ করানোর সময় তা বোঝাতে অনেক কষ্ট হয়। আমাদের মত হাত দিয়ে টাকা নিয়ে গুণতে পারে না, টেবিল বা কোনো কিছুর উপরে টাকা ছড়িয়ে রাখে, তারপর গুনে থাকে।
খাবারে সোয়াজিল্যান্ডবাসীর রয়েছে বৈচিত্র। এখানে প্রধান খাদ্য হল ভুট্টার গুড়া। পানি দিয়ে আটার মত সেদ্ধ করে ওরা খায়। এটাকে ওরা “পাপ”/ “পরেজ” বলে। এখানে সবজি আর মাছ পাওয়া যায় না বললেই চলে।সবজি বলতে আলু, টমাটো, পেয়াজ গাজর, আর পাতাকপি।
এরা বিভিন্ন ধরনের beans খায়। সবজি যা পাই তাই খাই আর কি মাঝে মাঝে পাশের দেশ মোজাম্বিক থেকে কিছু সবজিওয়ালি, মাছওয়ালি আসে, তখন একবারে বেশ কিছু কিনে রাখি।আর সাউথ আফ্রিকা এর থেকে নিজেরা নিয়ে আসি মাঝে মাঝে।
মাংস পুড়িয়ে খেতে এদের খুব পছন্দ। পোড়া মাংস কে এরা ব্রাই বলে থাকে। বিশেষ দিনগুলিতে এরা এই মাংস খায়। আমরা যেমন নববর্ষ উদযাপন করি, তেমনি ওরাও বছরে প্রথমদিন ‘ব্রাই ডে’ হিসেবে পালন করে থাকে। সেদিন সবাই সব কাজ ফেলে পোড়া মাংস খায়। এখানের খাবারে কোনা ভেজাল নাই, এরা ভেজাল বোঝে না।
গরমকালে এখানে আম, লিচু, জাম আর লোকাল অনেক ফল পাওয়া যায়। এছাড়া সারাবছর অনেকরকম ফল পাওয়া যায়, রাস্তার পাশে আপেল, আঙুর, কলা,ওভাকাডো বিক্রি হয়। বিভিন্ন বাগানে বা রাস্তার পাশে ওভাকাডো গাছের নিচে ওভাকাডো বিক্রি করছে, কিন্তু কেউ গাছ থেকে না বলে নেয় না, কিনে খাচ্ছে। চিনির জন্য বিখ্যাত, তাই অনেক আখ পাওয়া যায় কিন্তু অনেক শক্ত আর মিষ্টি।
এখানকার মানুষ সন্ধ্যা ৭/৮ টার ভেতর ঘুমিয়ে যায় আর সকাল ৪টায় উঠে পড়ে। সকাল ৮টায় সব কিছু খুলে যায়, অফিস,মল, আবার বিকাল ৫টায় সবকিছু বন্ধ। রেস্তোরাগুলো রাত ৮টায় বন্ধ হয়। কিছু কিছু রেস্তোরা একটু দেরিতে মানে ৯/১০ টায় বন্ধ হয়।
এখানকার আবহাওয়া অনেক ভাল, মানুষের মনের মত একটু পর পর পরিবর্তন হয়ে থাকে। গরম দেখে গরম এর কাপড় পরে বের হব, ঘণ্টাখানেক পরে দেখা গেলো অনেক ঠাণ্ডা। তাই বাইরে বের হতে গেলে সব সময় গরম কাপড় সাথে রাখতে হয়। গরমে খুব গরম আবার শীতে অনেক ঠাণ্ডা এটা কখনও হয় না।
এখানকার মানুষের মাথায় চুল খুবই কম হয়। তাই এরা প্রতি মাসে মাথায় নতুন নতুন পরচুলা লাগায়। মাসে মাসে চুলের পেছনে অনেক টাকা খরচ করে। এশিয়ানদের চুল এরা খুব পছন্দ করে, হাত দিয়ে চুল টেনে দেখে আসল কি না। এরা খুব সচেতন খাওয়া দাওয়ার ব্যপারে, তেল, চিনি আর মসল্লা এরা পছন্দ করে না।তারপরও ভুট্টা খাওয়ার কারণে এরা বেশ মোটা হয়।
এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ খ্রিস্টান। তবে এরা সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এ দেশের রাজা প্রতি বছর বছর বিয়ে করে।এখন পর্যন্ত ১৬টা বউ আছে। প্রতি বছর আগস্ট মাসে একটা উৎসব হয়, নাম ‘রিড ডান্স’। ওখানে অনেক মেয়েরা অংশ নেয়। রাজা সবার নাচ দেখে একজন কে পছন্দ করে, তাকে বিয়ে করে।
এরা হাতে বানানো অনেক জিনিস বিক্রি করে। অনেক নিখুত করে হাতের কাজ করে। যত বড় বাড়ি বানাক না কেন,উপরে টিন দেয়। এমনকি বড় বড় ব্যাংক, অফিস, মল,সব কিছুর উপর টিন দেয়, তারা বলে একদম উপর তালায় ছাদ দেয়া মানে টাকা নষ্ট করা।
এদের লাইফস্টাইল একসময় আমার কাছে অনেক আশ্চর্য লাগলেও এখন খুব ভালো লাগে। তাদের সবার মধ্যে রয়েছে দারুণ সরলতা। দেশ থেকে দূরে থেকে দেশের জন্য যে অনুভব ও শূন্যতা, তা সোয়াজিল্যান্ডের বর্তমান প্রতিবেশীদের সরলতা দিয়ে দূর করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।- চ্যানেল আই
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন