আলোচিত ত্বকী হত্যা : ৬ বছরেও দাখিল হয়নি অভিযোগপত্র

নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার ছয় বছর (৬ মার্চ)। দেশব্যাপী আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত তাদের অনেকেই প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মামলাটি নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক হিসেবে মনিটরিং সেলে অন্তর্ভুক্ত হলেও এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব।

নিহতের পরিবারের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার অপেক্ষাতেই মামলাটির চার্জশিট দেয়া হচ্ছে না। হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা প্রভাবশালী হওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে বলেও অভিযোগ করে আসছেন নিহত ত্বকীর পরিবারের স্বজনরা। যার কারণে ত্বকী হত্যার বিচার নিয়ে হতাশা এবং সংশয়ের মধ্যে দিন কাটছে তাদের। একই সাথে আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা দরকার বলে মনে করছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

যেভাবে হত্যা করা হয় ত্বকীকে

২০১৩ সালের ৬ মার্চ রাতে নারায়ণগঞ্জ শহরের পুরান কোর্ট এলাকা থেকে অপহরণ করা হয় ইংরেজি মাধ্যমের মেধাবী শিক্ষার্থী তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে। অপহরণের দুইদিন পর ৮ মার্চ সকালে ত্বকীর লাশ ভেসে উঠে শহরের চারারগোপ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনি খালে। ঘটনার দিন রাতেই ত্বকীর বাবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় দণ্ডবিধি ৩০২/৩৪ ধারায় আসামি অজ্ঞাত উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর মামলাটির তদন্তভার দেয়া হয় ডিবি পুলিশকে। তবে ডিবি পুলিশের তদন্তে মামলাটির আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় রফিউর রাব্বির আবেদনের প্রেক্ষিতে ২৮ মে উচ্চ-আদালত মামলাটি তদন্ত করতে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‌্যাব) নির্দেশ দেন।

মামলার সর্বশেষ অবস্থা

ত্বকী হত্যা মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ বাবু জানান, ত্বকী হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে র‌্যাব ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে গ্রেফতার করলেও তাদের মধ্যে একজন কারাগারে এবং চারজনই উচ্চ আদালত থেকে জামিনে আছেন। গ্রেফতারকৃত আসামিদের মধ্যে দুই আসামি সুলতান শওকত ভ্রমর ও আসামি ইউসুফ হোসেন লিটন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশে র‌্যাবকে এই মামলার তদন্তের দায়িত্ব হস্তান্তর করে পুলিশ। র‌্যাব সদর দপ্তর পুরো মামলার তদন্ত ও তদারকি করছে।

এ ব্যাপারে নিহত ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি অভিযোগ করে বলেন, সরকার চায় না ত্বকী হত্যার বিচার হোক। তাই বিচার হচ্ছে না। কারণ, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবার জড়িত আছে। তিনি বলেন, এই সরকার বিচার না করলেও আমরা বিশ্বাস কোনো একদিন ত্বকী হত্যাকাণ্ডের বিচার হবেই।

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ছোট ভাই শেখ রাসেলের মৃত্যুবার্ষিকীর এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন তিনি দেশের সব শিশু হত্যাকাণ্ডের বিচার করবেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর সেই ঘোষণা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। এতে আমরা মর্মাহত। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার দাবি থাকবে অবিলম্বে ত্বকীসহ দেশের সব শিশু হত্যার বিচার করা হোক।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের ঢাকা বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান মাসুম বলেন, প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ঘোষণা দিয়ে ত্বকী হত্যার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করেছেন। এর কারণ হচ্ছে সরকারের প্রভাবশালী পরিবারকে আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী যদি মনে করেন ত্বকী হত্যার বিচার করবেন, তাহলে বিচার হবে। আর যদি প্রধানমন্ত্রী না চান তাহলে এই সরকারে আমলে ত্বকী হত্যার বিচার হবে না। তবে আমি আশা করি আমাদের বিচক্ষণ ও মানবতার প্রতীক প্রধানমন্ত্রী ত্বকী হত্যার বিচার করে দেশে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।

তদন্ত সংস্থা র‌্যাবের ভাষ্য

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব ১১ এর কমান্ডিং অফিসার (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্ণেল কাজী শামশের উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ত্বকী হত্যা মামলাটি একটি স্পর্শকাতর মামলা। এটার তদন্ত চলছে। কবে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে সেটা বলা কঠিন। তবে সময় লাগবে। নির্দিষ্ট সময় বলা যাচ্ছে না। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কি পর্যায়ে আছে সেটাও বলা যাচ্ছে না। তবে তদন্তে কোনো চাপ নেই। আমরা আমাদের মতো কাজ করে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, মামলাটি পুলিশের কাছে ছিল সেখান থেকে আমাদের কাছে এসেছে। সেজন্য নতুন করে আবারও তদন্ত করতে হচ্ছে। সেজন্য সময় লাগবে।

তিন দিনের কর্মসূচী

ত্বকী হত্যা ও বিচারহীনতার ৬ বছর উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো তিন দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ। ৬ মার্চ বুধবার সকাল সাড়ে আটটায় বন্দর এলাকায় ত্বকীর কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। বিকেল তিনটায় নারায়ণগঞ্জ চারুকলা ইনস্টিটিউট ও শেখ রাসেল পার্কে শিশু সমাবেশ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেনসহ অনেকে।

৭ মার্চ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকার তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে অনুষ্ঠিত হবে ‘ত্বকী একটি বিচার-হীনতার প্রতীক’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক। বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কামাল লোহানী, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. শাহদীন মালিক, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ড. সফিউদ্দিন আহমদ, ডা সারোয়ার আলী, মামুনুর রশীদ, মফিদুল হক, অধ্যাপক শফি আহমেদ, অধ্যাপক এম.এম. আকাশ, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, খালেকুজ্জামান, জোনায়েদ সাকী, খোন্দকার মুনিরুজ্জামান, নূরুল কবীর, মিজানুর রহমান খান, গোলাম মুর্তোজাসহ সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ।

৮ মার্চ শুক্রবার বিকাল সাড়ে তিনটায় নারায়ণগঞ্জ শহরের ডিআইটি চত্বরে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সমাবেশে উপস্থিত থাকবেন মানবাধিকার সংগঠক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালসহ স্থানীয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।