‘গণতন্ত্রের শর্তগুলো ভিত্তি পায়নি ৪৮ বছরেও’

বাংলাদেশে এবার স্বাধীনতার ৪৮তম বার্ষিকী উদযাপন করা হচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন দেশটিতে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, এবং বাকস্বাধীনতার অবস্থা নিয়ে গুরুতর সব প্রশ্ন উঠছে। স্বাধীনতার চেতনার অন্যতম ভিত্তি বলে বিবেচিত এই বিষয়গুলো এত বছর পরও কেন বাংলাদেশে নিশ্চিত করা যায়নি? খবর বিবিসি বাংলার।

এবছরের স্বাধীনতা দিবসে বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচিতেও বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার নিশ্চিত করার দাবিগুলো উঠে এসেছে।

মানবাধিকার কর্মিরা অভিযোগ করেছেন, ভিন্নমতের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণু অবস্থান নিয়ে সরকার কথা বলার স্বাধীনতা মারাত্নকভাবে সংকুচিত করেছে।দেশে একটা ভয়ের সংস্কৃতি চালু হয়েছে বলে তাদের অভিযোগ।

আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রায়ই কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া বা গুমের অভিযোগ অব্যাহত আছে।

মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন, বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এখন আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশ্ন উঠছে।তবে এর পেছনে একটা প্রেক্ষাপট আছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

তাঁর মতে, বিভাজনের রাজনীতির কারণেই পরিস্থিতি একটা চরম অসহিষ্ণু অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।

“দীর্ঘ ২০ বছর তো বাংলাদেশ সেই ধরণের একটা শাসনের মধ্যে থাকলো। সামরিকতন্ত্র, সেখানে ধর্মকে ফিরিয়ে আনা, বিভাজনের রাজনীতি, তারপর একে অপরকে বিশ্বাস না করা, ঐ সময় কতগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে – সবকিছু মিলে স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পরিবেশটাই তো নষ্ট হয়ে যায়।”

“তারপরে যখন মুক্তিপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এলো, তারা এমন একটা নাজুক অবস্থার মধ্যে নিজেদেরকে পেলো যে, গণতন্ত্রের যে শর্তগুলি, সেগুলি চর্চা করতে দিতে তারা যেন কোথাও কোথাও দ্বিধাগ্রস্ত থাকতো। কোথাও না কোথাও তারা একটা সন্দেহের মধ্যে থাকতো।”

“যতদিন জনগণের প্রতি আস্থা প্রতিষ্ঠা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত যে বিষয়গুলো নিয়ে আজ প্রশ্ন উঠছে, প্রশ্ন উঠতেই থাকবে।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, জেনারেল এরশাদের শাসনের পতনের পর ১৯৯১ সালে যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ফিরে আসে, তখন থেকে নজর দেয়া হয়েছিল মূলত নির্বাচনী প্রক্রিয়ার দিকে। সেকারণে বাকস্বাধীনতা বা মানবাধিকারসহ গণতন্ত্রের অন্যান্য যে সব শর্ত রয়েছে, সেগুলো কোনো ভিত্তি পায়নি।

তবে এখন নির্বাচনও বড় প্রশ্নের মুখে পড়েছে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রওনক জাহান বলছিলেন, বড় দু’টি দল সব সময় একে অপরের প্রতি অসহিষ্ণু থাকায় পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়েছে।

“যখন ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে।১৯৯১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রত্যেক নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে।কিন্তু তখনও যখন যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা কিন্তু বিরোধীদলে যারা থাকতো, তাদের ওপর অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক নানা উপায়ে নিপীড়ন করেছেন।”

“আর ২০০৯ সারের পর থেকে ক্ষমতার পালাবদল হয়নি। অতএব যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা তাদের অবস্থান আরও সুসংহত করতে পেরেছেন এবং যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা আরও বেশি কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠবেন।”

সিনিয়র সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ পরিস্থিতিটাকে দেখেন ভিন্নভাবে।

তিনি মনে করেন, আওয়ামী লীগ যে টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় রয়েছে, এই সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরোধী শক্তি দূর্বল হয়ে পড়েছে।

মি: আহমেদ বলেছেন, শক্তিশালী বিরোধী অবস্থানে কেউ থাকতে না পারায় সরকার কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে।

এমন পরিস্থিতির কারণে মুক্তিযুদ্ধের যা মুল চেতনা – সেই গণতন্ত্র, মানবাধিকার বা বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

“আমাদের একটা কার্যকরী বিরোধীদল দরকার।এবং বিএনপি বিরোধীদল হিসেবে তাদের রোলটা প্লে করতে পারছে না।যে কারণে সরকার ক্রমান্বয়েই কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে। একারণেই এখানে গণতন্ত্র্রের বিকাশ ঘটবে না, মানবাধিকার লংঘিত হবে এবং সংবাদপত্রের বা মিডিয়ার স্বাধীনতা বার বার খর্ব করা হবে।”

বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, সরকার যেহেতু এখন কোনো বিষয়ে চাপ অনুভব করছে না বা চাপ সৃষ্টির মতো রাজনৈতিক শক্তি সেভাবে নেই।

সেই প্রেক্ষাপটে সরকার নিজেই বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার বা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করার ব্যাপারে কাজ করতে পারে।

তবে সরকার বা আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতার সাথে কথা বললে তারা মানবাধিকার লংঘন বা বাকস্বাধীনতা খর্ব করার সব অভিযোগই প্রত্যাখ্যান করেন।