করোনার হানা: কুমিল্লার ঐহিত্যের ‘খাদি পোশাক’ শিল্পে লোকসানে পেশা ছাড়ছেন উদ্যোক্তা ও কারিগররা

কুমিল্লার ঐতিহ্যবাদী খাদি পোশাকের কদর সারা বছর থাকলেও বিক্রির অন্যতম প্রধান মৌসুম বৈশাখে ব্যবসায় মন্দার কারণে বিপাকে উদ্যোক্তারা। ঈদকে কেন্দ্র করে রোজার শুরুতে যে কেনাকাটা হয়, সেটিও বন্ধ এখন।

করোনা সংক্রমণের কারণে পর পর ‍দুই বছর বৈশাখ আর ঈদের উৎসব আসেনি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে। অথচ পোশাক তৈরি হয়েছিল ঠিকই।

নববর্ষ উপলক্ষে বানানো শাড়ি-পাঞ্জাবি-সালোয়ার-কামিজ নিয়ে বসে আছেন ব্যবসায়ীরা। নতুন অর্ডার নেই, তাই শ্রমিকদের হাতেও কাজ নেই। আগামী ঈদে বিক্রি হবে- এমন ভরসাও এখন করতে পারছেন না তারা।

কুমিল্লার খাদিশিল্পের প্রধান কেন্দ্র চান্দিনা ও দেবিদ্বারে। তবে গত বছর করোনার আগমন এই শিল্পের কোমরে যেন লাঠির আঘাত পড়েছে।

তাঁতিরা জানান, ১০ বছর আগে অন্তত দেড়’শ তাঁতি ছিল। তাদের কাপড় বিদেশেও যেত। তবে সেই রমরমা দিনের অবসান হয়েছে। এখন ৩০ থেকে ৩৫ জন ধরে রেখেছেন পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যবাহি এ পেশা।

চান্দিনায় সবচেয়ে বড় তাঁত ছিল প্রফুল্ল দেবনাথের। বছর দেড়েক আগে তিনি বাপ-দাদার পেশাটি একেবারে ছেড়ে দেন। তিনি বলেন, ‘এমনিতে নানান সমস্যায় আছে খাদি। তার ওপর গত বছর লকডাউনের কারণে বৈশাখ-রমজানের ঈদ-কোরবানির ঈদে কোনো বেচাবিক্রি নেই। তাই বাধ্য হয়ে অনেকে তাঁত ও খাদির ব্যবসা ছেড়ে দিছে। আমি তো মনের দুঃখে দুই বছর আগেই বাপ-দাদার ব্যবসা ছেড়ে দিছি।’

কুমিল্লা মহানগরীতে এখন ১৫০ থেকে ২০০টি খাদি বিতান রয়েছে। পুরো জেলায় আছে আড়াই শতাধিক খাদির দোকান। গত বছর পয়লা বৈশাখ-রমজান ও কোরবানির ঈদে বেচাকেনা করতে পারেননি ব্যবসায়ীরা।

খাদি ভূষণের মালিক চন্দন দেব রায় বলেন, ‘বর্ষবরণ-রমজান ও কোরবানির ঈদেই বেশি বিক্রি হয় খাদির পোশাক। গত লকডাউনের কারণে ব্যবসায়ীরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়েছে বলে বেশ বড় ক্ষতির সম্মুখীন হন।’ এবারও বিক্রির মৌসুমেই পড়েছে লকডাউন।

তিনি জানান, স্বাভাবিক সময়ে পয়লা বৈশাখ ঘিরে ব্যবসায়ীরা গড়ে লাখ টাকার খাদি পোশাক বিক্রি করেন। কিন্তু সেটি গত দুই বছরে হয়নি। কেবল এই মৌসুমেই দেড় থেকে দুই কোটি টাকার বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে।

বিধিনিষেধের কারণে গত বছর রোজাতেও বেচাকেনা ছিল বন্ধপ্রায়। এবারও কী পরিস্থিতি হয়, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন চন্দন দেব। বলেন, ‘প্রতিটি ঈদে একেকজন ব্যবসায়ী ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার খাদি কাপড় বিক্রি করেন। এবার হিসাব করলেই দেখবেন গত বছর ও চলতি বছর ব্যবসায়ীরা কত টাকার ক্ষতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন।’

আরেক ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন জানান, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, ইউরোপের দেশসহ প্রায় ১০টি দেশে কুমিল্লার খাদি কাপড় রপ্তানি হতো। লকডাউনের কারণে সে রপ্তানিও বন্ধ হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ‘খুবই করুণ সময় চলছে খাদির। সময় না পাল্টালে আর যদি সহায়তা না মেলে, তাহলে হয়তো কুমিল্লায় খাদিশিল্পের বিলুপ্তি ঘটবে।’

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, ‘কুমিল্লা জেলা প্রশাসন খাদিকে ব্র্যান্ডিং করা শুরু করেছে। জেলা প্রশাসনের যেকোনো প্রোগ্রামে খাদির পোশাক পরা হয়। এতে করে খাদির প্রচলন বাড়বে। এ ছাড়াও খাদির সংকট উত্তরণে আমরা আরও কিছু পদক্ষেপ নেব। আশা করি, খাদি তার পুরোনো ঐতিহ্য ফিরে পাবে।’