বিশিষ্ট ব্যক্তি ও দেশি-বিদেশি সংগঠনের তীব্র নিন্দা

কারাগারে রোজিনা, ক্ষুব্ধ গণমাধ্যমকর্মীরা

দুর্নীতির খবর প্রকাশকারী বলে পরিচিত প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে আটকে রেখে হেনস্তা, গ্রেপ্তার, মামলা ও কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় ক্ষুব্ধ বাংলাদেশের গণমাধ্যমকর্মীরা।

গত সোমবার বিকাল থেকেই সারা দেশে গণমাধ্যমকর্মীরা এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ চালিয়ে যাচ্ছেন। ঘটনাটি স্থান পেয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও। এ ছাড়াও এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন, মানবাধিকার সংস্থা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।

অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-১৯২৩ এর ৩ ও ৫ ধারা এবং পেনাল কোডের ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় করা মামলায় গতকাল মঙ্গলবার রোজিনাকে আদালতে তোলা হয়। তার বিরুদ্ধে পুলিশের পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিম এ নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে জামিন আবেদনের বিষয়ে শুনানির জন্য আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২০ মে) দিন ধার্য করেছেন আদালত।

শুনানি শেষে আদালত থেকে বের হওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমার প্রতি অন্যায় হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ে রিপোর্ট করায় আমার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে। রিমান্ড শুনানিতে আদালতে কোনো সাংবাদিককে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। শুনানিকালে এজলাসকক্ষে আইনজীবীদের নির্ধারিত বেঞ্চে রোজিনাকে বসানো হয়। বিচারক এজলাসকক্ষে প্রবেশ করলে তিনি দাঁড়িয়ে যান। এ সময় আইনজীবীর মাধ্যমে অনুমতি নিয়ে ফের তিনি বেঞ্চে বসেন। তার পক্ষে বেশ কয়েকজন আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে শুনানি করেন। তবে এ সময় রোজিনাকে বিচারক কিছু জিজ্ঞাসা করেননি এবং তিনি নিজ থেকেও কিছু বলেননি। তবে সিএমএম আদালতের এজলাসকক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকরা রোজিনাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনার কিছু বলার আছে কি না?

জবাবে রোজিনা বলেন, আমার সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ে রিপোর্ট করায় আমার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে। আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে পুলিশ তাকে সরিয়ে নেয়। এরপর প্রিজন ভ্যানে তাকে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

সকালে আদালত চত্বরে রোজিনার স্বামী মনিরুল ইসলাম মিঠু বলেন, রোজিনাকে নির্যাতন করা হয়েছে। তাকে অ্যাসল্ট করা হয়েছে, গলা টিপে ধরা হয়েছে। জোর করে তার মোবাইল নিয়ে নেওয়া হয়েছে। সোমবার রোজিনা ইসলাম সচিবালয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেলে তাকে পাঁচ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। রাতে তাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরির অভিযোগে মামলা করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ ঘটনার সঙ্গে অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসা বেগম, সহকারী সচিব জাকিয়া পারভীন, পুলিশ কনস্টেবল মিজানসহ যারা জড়িত ছিলেন তাদের নামে মামলা করব। আমরা আমাদের উকিলের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আসার পর তার সঙ্গে আলোচনা করে মামলা করা হবে।

রোজিনা হেনস্তার প্রতিবাদে ও তার মুক্তির দাবিতে গতকাল বিকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেন তার সহকর্মীরা। এ সময় তারা রোজিনার বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার এবং তাকে অপদস্থকারীদের তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনারও দাবি জানান।

এই মানববন্ধনে প্রথম আলোর সাংবাদিক, বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত কর্মীরা ছাড়াও বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক, সাংবাদিক সংগঠনের নেতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, উন্নয়নকর্মীরা অংশ নিয়ে সংহতি প্রকাশ করেন। এ সময় তাদের হাতে ‘বিপন্ন সাংবাদিকতা, কাঁদছে দেশ’, ‘রোজিনা ইসলামের মুক্তি চাই’, ‘স্বাধীন দেশে স্বাধীন গণমাধ্যম চাই’, ‘সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ কী’, ‘সাংবাদিকতা অপরাধ নয়’, ‘সাংবাদিকতাসংশ্লিষ্ট কালো আইন বাতিল চাই’, বাক্স্বাধীনতা সাংবিধানিক অধিকার ইত্যাদি স্লোগান লেখা পোস্টার ছিল।

প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, রোজিনা ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা করছেন। তার সুনাম দেশে ও দেশের বাইরে। সাংবাদিকতার জন্য বহু পুরস্কার পেয়েছেন। তার সাংবাদিকতার মূল শক্তি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। তিনি অনেক কিছু উন্মোচন করেছেন এবং তার প্রতিবেদন ধরে সরকার সংশোধনমূলক পদক্ষেপও নিয়েছে।

বর্তমানে করোনার কারণে জনস্বাস্থ্য খাত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রোজিনা স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে রিপোর্ট করছিলেন। এসব রিপোর্টের কারণে যারা বিক্ষুব্ধ হয়েছে, তাদের আক্রোশের শিকার হয়েছেন তিনি। তাকে যেভাবে সচিবালয়ে আটকে রাখা হয়েছে, সেটার কোনো কারণ ছিল না। বিষয়টি আইনের পথেই মোকাবিলা করা হবে। আমরা আদালতের প্রতি আস্থাশীল। আশা করি ন্যায়বিচার পাব।

রোজিনা তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে সচিবালয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কোনো অন্যায় করতে যাননি। তার সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে মানুষ উপকৃত হয়েছে, সাংবাদিকতা উপকৃত হয়েছে, দেশ উপকৃত হয়েছে। দেশের সংবিধানে বাক্স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল অ্যাক্টসহ যেসব আইন হয়েছে, সেগুলো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে বাক্স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জন করেছি, তার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। এগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতার পথকে সংকুচিত করেছে।

রোজিনা নামে করা মামলা নিঃশর্তভাবে প্রত্যাহার এবং তার মুক্তির দাবি জানিয়েছেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক। বলেন, এটি আইনি প্রক্রিয়ার বাইরেও হতে পারে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও হতে পারে। আজ রিমান্ডের আবেদন না করলে আমরা রোজিনার জামিনও পেতে পারতাম। একজন নাগরিক হিসেবে আমরা মনে করি, রোজিনার বিরুদ্ধে করা মামলাটি মিথ্যা মামলা। তার নিঃশর্ত মুক্তি চাই, মামলা প্রত্যাহার চাই এবং তাকে অপদস্থকারীদের তদন্ত ও দায়ীদের বিচার চাই। তাকে হেনস্তাকারীরা সারা বিশ্বের সামনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। বিশ্ব দেখছে, এই দেশটি সাংবাদিক নিপীড়নকারী এবং গণমাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে এমন একটি দেশ। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা চাই, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা রাষ্ট্রের জন্য, সরকারের জন্য এবং সুশাসনের জন্য দরকার।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি মুরসালিন নোমানী মানববন্ধনে বলেন, রোজিনা ইসলামের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে থামাতে পরিকল্পিতভাবে সাজানো নাটক করা হয়েছে। এই ঘটনা সরকার ও সাংবাদিকদের মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা কি না, সেটি তদন্ত করা দরকার।

সাংবাদিক রোজিনাকে নির্যাতন ও মামলার বিষয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য রোজিনা ইসলামের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি আছে। এমন একজন সাংবাদিককে হেনস্তা করা অন্যায়, অনভিপ্রেত। কী কারণে তাকে আটকে রাখা হয়েছে বিষয়টির তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। বৃহস্পতিবার যে জামিন শুনানি হবে, সেখানে রোজিনা জামিন পাবেন বলে আশা করছি। গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তিনি এ কথা বলেন।

এ সময় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান বলেন, আমরা জানতে পেরেছি রোজিনাকে ফিজিক্যালি টর্চার করা হয়েছে। আমরা সুস্থ বিচার দাবি করেছি। তারা বলেছে আধাঘণ্টা পর পুলিশে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু মূলত কয়েক ঘণ্টা তাকে ছোট একটি রুমে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। মানসিক ও শারীরিকভাবে তাকে বিভিন্ন ধরনের হেনস্তা করা হয়েছে। সেটি যাতে সুষ্ঠু তদন্ত হয় সে বিষয়ে আমরা দাবি জানিয়েছি।

রোজিনা ইসলামের বড় ভাই মো. সেলিম বলেন, আমরা তার স্বাস্থ্য নিয়ে উৎকণ্ঠার মধ্যে আছি। আর বিগত দিনে যা হয়েছে সেগুলো সম্পর্কে আপনারা অবগত আছেন। আজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলাম তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে রোজিনার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। আমরা সেই আশার ওপর আস্থা রেখে এগিয়ে যেতে চাই। দোয়া করবেন আমার বোন যাতে সুস্থ থাকে আবার আপনাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারে।

রোজিনার মুক্তি ও পুরো ঘটনার স্বাধীন তদন্ত দাবি করেছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের সংগঠন (ডিকাব)। একই সঙ্গে গত সোমবার সাংবাদিক রোজিনাকে ঘিরে সংঘটিত সব ঘটনার স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদন্ত দাবি করেছে সংগঠনটি। ডিকাবের পক্ষে এর প্রেসিডেন্ট পান্থ রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এ কে মঈনুদ্দিন গতকাল মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এ দাবি জানান।

সচিবালয়ে রোজিনা ইসলামকে হেনস্তার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ, ক্ষোভ, তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে সম্পাদক পরিষদের নেতারা বলেন, কর্তব্য পালন করতে গিয়ে প্রায় ৬ ঘণ্টা হেনস্তার পর প্রথম আলোর সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে থানায় সোপর্দ, মামলা দায়ের, সারা রাত থানায় রাখা, আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ডের আবেদন, জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ, ক্ষোভ প্রকাশ, তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে সম্পাদক পরিষদ।

রোজিনাকে হেনস্তা ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়েছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তারা এ ঘটনা স্বাধীন সাংবাদিকতার টুঁটি চেপে ধরার শামিল হিসেবে বর্ণনা করেছে। এক বিবৃতিতে সংস্থাটি অবিলম্বে তার মুক্তি ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে এ ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিবেচনাবোধের পরিচয় দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

রোজিনাকে সচিবালয়ে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে হেনস্তার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। একই সঙ্গে ঘটনার প্রকৃত ব্যাখ্যা চেয়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়েছে কমিশন। গতকাল এক বিবৃতিতে কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, গণমাধ্যম সূত্রে আমরা জেনেছি, অনুমতি ছাড়া করোনার টিকা সরকারি নথির ছবি তোলার অভিযোগে দৈনিক প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখে হেনস্তা হয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়। দীর্ঘ সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের কক্ষে একজন সাংবাদিককে আটক রাখার বিষয়টি নিন্দনীয়।

সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে লাঞ্ছনা এবং তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য চুরির অভিযোগ আনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। গতকাল সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা এ ঘটনার প্রতিবাদ জানান। বিবৃতিদাতারা হলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, অধ্যাপক অনুপম সেন, নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, সারোয়ার আলী, বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, বীর মুক্তিযোদ্ধা, নাট্যনির্দেশক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ ও আবদুস সেলিম।

তারা বলেন, করোনার দুর্যোগকালে সংকট মোকাবিলায় সরকার ও জনগণের যে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস পরিচালিত হচ্ছে তা সর্বতোভাবে জোরদার করার লক্ষ্যে আমরা সবাই সমবেত রয়েছি। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্যকর্মীরা গুরুদায়িত্ব পালন করছেন। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির কারণে সরকারও বিভিন্ন সময় বিব্রত হয়েছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। এ ক্ষেত্রে রোজিনা ইসলামসহ অন্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সহযোগিতার মাধ্যমে সরকার উপকৃত হয়েছেন। তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার এবং দুর্নীতির প্রতি শূন্য সহনশীলতা, সরকারের ঘোষিত এই দুই নীতির সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গৃহীত পদক্ষেপ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

উল্লেখ্য, গত সোমবার বিকালে পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সচিবালয়ে গেলে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আটকে রেখে শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয় সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে। রোজিনা ইসলাম পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সেদিন বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সচিবালয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান। পরে খবর পাওয়া যায় তাকে সেখানে কর্মকর্তারা একটি কক্ষে আটকে রেখেছেন। তাকে আটকে রাখার খবর পেয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওই ভবনে যান। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে রোজিনাকে আটকে রাখার কারণ সম্পর্কে গণমাধ্যমকর্মীরা জানতে চাইলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কিছুই জানাননি। একপর্যায়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু নথি সরানোর অভিযোগ এনে পুলিশ ডাকা হয়েছে। পরে রোজিনা ইসলামকে শাহবাগ থানায় নিয়ে রাখা হয়।

পুলিশ জানায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে থানায় আনা হয়েছে। রাতে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব ডা. শিব্বির আহমেদ ওসমানী এ মামলা দায়ের করেন। সাংবাদিক রোজিনার বিরুদ্ধে অনুমতি ছাড়া মোবাইল ফোনে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ নথির ছবি তোলা এবং আরও কিছু নথি লুকিয়ে রাখার অভিযোগ এনেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে সাংবাদিকেরা বিকালে সচিবালয়ে এবং রাতে শাহবাগ থানার সামনে বিক্ষোভ করেন।

মামলাটি ত্রুটিপূর্ণ : সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের মামলাটি একটি ত্রুটিপূর্ণ বলেছেন তার আইনজীবীরা। দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ এবং অফিশিয়ালস সিক্রেসি অ্যাক্ট ৩ ও ৫ ধারায় তার বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছে সেটি মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করেছেন আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী। শুনানিতে আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, এই মামলাটি একটি ত্রুটিপূর্ণ মামলা। কেননা এই মামলায় যে ডকুমেন্টের কথা বলা হয়েছে ওই ডকুমেন্টের কথা মামলার এজাহারে বর্ণনা নেই। মামলায় যে জব্দ তালিকা দেখানো হয়েছে এই জব্দ তালিকার ডকুমেন্টও আসামির কাছ থেকে উদ্ধার হয়নি। তা উদ্ধার হয়েছে একজন সরকারি কর্মকর্তার কাছ থেকে। কাজেই আসামির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা মিথ্যা ও মানহানিকর।

তিনি আরো বলেন, আমরা আদালতকে বলেছি যদি দণ্ডবিধি ৩৭৯ ধারা বিশ্বাস করতে হয় তাহলে চুরি হতে হবে প্রকাশ্য স্থানে অথচ ঘটনাটি ঘটেছিল সচিবালয়ে। তিনি তার মহান পেশা পালন করতে গিয়ে সচিবালয়ে গিয়েছিলেন। তা ছাড়া এরই মধ্যে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন। তিনি মহান পেশা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আজকে পরিস্থিতির শিকার। আমাদের বক্তব্য আদালত শুনে রিমান্ড নামঞ্জুর করেন। এর পর জামিন শুনানির জন্য ২০ মে দিন ধার্য করেন।

আদালতে রোজিনা ইসলামের পক্ষে শুনানি করেন, প্রথম আলোর নিয়োজিত আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী, আশরাফ উল আলম, প্রশান্ত কুমার কর্মকার। এ ছাড়া আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পক্ষে আইনজীবী আব্দুর রশীদ, ব্লাস্টের পক্ষে আইনজীবী মশিউর রহমান এবং আইনজীবী সুমন কুমার রায় শুনানিতে ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু।