প্রসঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ : মুরাদনগরের চাপিতলা শহীদদের কথা

১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার রাজা চাপিতলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহীনির সাথে সম্মুখ যুদ্ধে ৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ ৫১ জন নারী-পুরুষ শহীদ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাঙালি জাতির গৌরবময় ইতিহাস ও বীরত্বে গাঁথা রাজা চাপিতলা গ্রামে পাক হানাদারদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ সমরের স্মৃতি রক্ষার্থে স্বাধীনতার ৫০তম বছরেও কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ হয়নি। উপেক্ষিত স্থানীয়দের দাবি রাজা চাপিতলা গ্রামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ, গণহত্যায় নিহত শহীদদের কবর সংরক্ষণ, যুদ্ধাহত ও শহীদ পরিবারের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানসহ পুনর্বাসন করা হোক।
স্বাধীনতাযুদ্ধে পিতা-মাতা হারা চাপিতলা গ্রামের হাবিবুর রহমান জাফর , শিশু মেম্বার ও আব্দুল মজিদ জানান, ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর পাকিস্তানি হানাদাররা তার পিতা-মাতাকে হত্যাসহ বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে সর্বস্বান্ত করে দেয়। শহীদ পরিবারের একজন সদস্য হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার ৫০তম বছর কেটে গেল, কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। বাধ্য হয়ে জীবিকা নির্বাহে ঢাকায় সংবাদপত্রের হকারি করি। তার দাবি কেউ খোঁজ না নিলেও শহীদদের কবরগুলো যেন সরকারিভাবে সংরক্ষণ করে একটি স্মৃতিসৌধ করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় সমাজসেবী জুয়েল আহম্মেদ জানা যায়, পাকিস্তানি আর্মির কাছে তথ্য ছিল মুরাদনগরের থানা কমান্ডার কামরুল হাছান ভূঁইয়া তার মুক্তিবাহীনি নিয়ে অবস্থান করেছেন পীরকাশিমপুর ক্যাম্পে। তাই পীর কাশিমপুর ক্যাম্প আক্রমণের উদ্দেশ্যে তারা সড়ক পথে এসে চাপিতলায় পৌঁছে। এই খরব মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারলে প্রতিরোধ গড়েতোলার জন্য চাপিতলা ব্রিজের গোড়ার দুই পাশের মাটি সরিয়ে উত্তরে পাশে অবস্থান নেয়।
এ সময় উভয়পক্ষের মধ্যে তুমুল গুলি বিনিময় হয়। এতে চাপিতলা গ্রামের ৩ মুক্তিযোদ্ধাসহ ৫১ জন নারী-পুরুষ শহীদ হয়েছেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেনÑ পুস্কুরিণীর পাড় গ্রামের হাবিলদার রমিজ উদ্দিন, বলিঘর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশার, কদমতলী গ্রামের বাচ্চু মিয়া।
এই যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ২ দুইজন কমান্ডারসহ অনেক সৈন্য নিহত হয়। এতে ওরা ক্ষিপ্ত হয়ে আরো হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে এগোতে থাকে। ২১ জন নারীর শ্লীলতাহানী, ৪৫টি বাড়ি-ঘর, ও শতাধিক গবাদি পশু পুড়িয়ে দেয়।
চাপিতলা ইউপি সাবেক চেয়ারম্যান মামুনুর-রশিদ ভূঁইয়া জানান, শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য আমি ২০০৬ সালের ১২ মার্চ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট আবেদন করি। বিষয়টির প্রতিবেদন দেয়ার জন্য তিনি সমাজসেবা কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন । ওই বছরের ২৫ এপ্রিল উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সরেজমিন পরিদর্শন শেষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন ।
মুুরাদনগর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার হারুনুর রশিদ বলেন, চাপিতলা হচ্ছে মুরাদনগরের অনেক বড় একটি যুদ্ধ ক্ষেত্র। এখানে সম্মুখ যুদ্ধে আমাদের তিন সহযোদ্ধা নিহত হন। এ যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনী অনেক মা-বোনের ইজ্জত হরণসহ বাড়িঘর ,গবাদি পশুর ওপর অগ্নিসংযোগ করেন। তাই চাপিতলা যুদ্ধের ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের নিকট রেখে যেতে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হোক।
চাপিতলা ইউনিয়ন পষিদের চেয়ারম্যান মো. কাইয়ূম ভূইয়া জানান, এখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করার ব্যাপারে আমি এমপি আলহাজ ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন ( এফসিএ) মহোদয়ের সাথে পূর্বে কথা বলেছি। আবারও এব্যাপারে কথা বলব। আমি চাই শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণে, এই গ্রামে একটি স্মৃতিসৌধ হোক।
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সফিউল আহমেদ বাবুল বলেন, বধ্যভূমিসহ এই সকল স্থানগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। মুরাদনগরের চাপিতলা নিয়ে কেউ এখনো আমাদের বলেনি। যেহেতু আমি এখন শুনেছি ইনশাল্লাহ্ এই বিষয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য কাজ শুরু করব।