পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার ৫২ বছর পূর্ণ করল বাংলাদেশ
২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর মেশিনগান ও কামান-ট্যাংক নিয়ে সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
তারা সেই সেনা অভিযানের সাংকেতিক নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। সেই রাত থেকেই সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল বাঙালি। ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।
২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একাধিক গণকবর খুঁড়ে শত শত মৃতদেহ মাটিচাপা দিয়ে তার ওপর বুলডোজার চালিয়েছিল। ঢাকার অন্যান্য এলাকায়ও একইভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, খুলনা, যশোর, রংপুর, সৈয়দপুর ও সিলেটেও চলেছিল সামরিক অভিযান।
অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা লেখা হয়েছিল একটি সাধারণ কাঠপেনসিল দিয়ে। ২৫ মার্চ অভিযান চালানোর এক সপ্তাহ আগে এর পরিকল্পনা করেছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা।
যখন এই অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তখন ঢাকা ছিল রাজনৈতিক দিক থেকে চরম উত্তেজনাপূর্ণ। গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করায় ঢাকা তখন বিক্ষোভের নগরী। এরই মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দিয়েছেন ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে।
এর আগেই ঢাকায় ওড়ানো হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। অন্যদিকে ঢাকায় তখন চলছে শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়া খানের মধ্যে বৈঠক। যেখানে অংশ নিতে জুলফিকার আলী ভুট্টোও তখন ঢাকায় ছিলেন। এমন প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়েছিল অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা।
পরিকল্পনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী শত্রু হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানা এবং বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মীদের চিহ্নিত করেছিল। সে জন্য তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ ও ইকবাল হলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ওপর প্রথম আক্রমণ চালায়।
যেভাবে পরিকল্পনা
১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা ঢাকায় দায়িত্বরত ছিলেন, তাদের অনেকেই অবসরের পর স্মৃতিকথা লিখেছেন। তাদের কেউ কেউ লিখেছেন, রাজনৈতিক সমঝোতা ব্যর্থ হলে পাকিস্তানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সামরিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং সেই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা করা হয়।
আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি ইস্ট পাকিস্তান ১৯৬৯-১৯৭১ শিরোনামে স্মৃতিচারণামূলক বই লিখেছেন মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা। ১৯৭১ সালে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর ১৪তম ডিভিশনের জিওসি ছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে কর্মকর্তারা অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা।
বইয়ে খাদিম হুসাইন রাজা লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান তাকে এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে কমান্ড হাউসে ডেকে পাঠান। তারা দুজন সেখানে যাওয়ার পর টিক্কা খান তাদের বলেন, শেখ মুজিবের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলোচনায় প্রত্যাশিত অগ্রগতি হচ্ছে না। সে কারণে ইয়াহিয়া খান ‘মিলিটারি অ্যাকশন’-এর জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন।
ইয়াহিয়া খানের বরাত দিয়ে টিক্কা খান সেনা কর্মকর্তাদের একটি পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেন। মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা তার বইয়ে আরও লিখেছেন, সেই নির্দেশ অনুযায়ী পরদিন ১৮ মার্চ ক্যান্টনমেন্টে তার বাসায় রাও ফরমান আলী আসেন।
তারা দুজন মিলে অপারেশন সার্চলাইটের খসড়া তৈরি করেন। তারা দুজন আলাদা দুটি পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। সে অনুযায়ী রাও ফরমান আলী ঢাকা অঞ্চলে সামরিক অভিযানের দায়িত্ব নেন এবং খাদিম হুসাইন রাজা দায়িত্ব নেন ঢাকার বাইরে।
সেই খসড়া নিয়ে তারা সন্ধ্যায় যান কমান্ড হাউসে। সেখানে অল্প সময়ের মধ্যেই তা অনুমোদন করা হয়। এরপর বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন ১৯ মার্চ থেকে। সে অনুযায়ী ঢাকায় সশস্ত্র আক্রমণ চালানো হয় ২৫ মার্চ মধ্যরাতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস আক্রমণে সেই ২৫ মার্চের রাত ছিল বিভীষিকাময়। অনেক শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়। রেহাই পাননি অনেক শিক্ষকও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার আবাসিক এলাকায় ৩৪ নম্বর ভবনের নিচতলায়। ২৫ মার্চ দিবাগত রাত দুইটার দিকে রান্নাঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে এক পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা।
শোবার ঘরে গিয়ে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। একই ভবনের তিনতলা থেকে নেওয়া হয় পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক এ এন এম মুনীরউজ্জামানকেও।
জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মেয়ে মেঘনা গুহঠাকুরতা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ১৯৭১ সালে তিনি দশম শ্রেণিতে পড়তেন। সেই রাতের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, তার বাবাকে টেনে ঘর থেকে বের করে নেওয়ার পর আটটি গুলির শব্দ তারা শুনতে পান। তখন অধ্যাপক মুনীরউজ্জামানের স্ত্রী সৈয়দা মাহমুদা জামান নিচে নেমে দেখেন, জ্যোতির্ময়ের দেহে প্রাণ আছে। তার ঘাড়ে ডান দিকে গুলি করেছে। শরীর অবশ। কিন্তু অধ্যাপক মুনীরউজ্জামান সেখানেই মারা যান। পরে ৩০ মার্চ হাসপাতালে মারা যান জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ভবনে ঢুকে হত্যা করে দর্শনের অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র (জি সি) দেবকে। তার লাশ মাটিচাপা দেয় হলের মাঠে।
সেই রাতে একই সঙ্গে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ও পিলখানায় সশস্ত্র আক্রমণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ওয়্যারলেস অপারেটর ছিলেন শাহজাহান মিয়া। তিনি বলেন, রাত সাড়ে ১০টার দিকে তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। তখন তারা ব্যারাক থেকে অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। রাত পৌনে ১২টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করলে তারা প্রতিরোধ গড়েছিলেন। কিন্তু অস্ত্র ও গুলি কম থাকায় তারা টিকতে পারেননি।
গবেষক আফসান চৌধুরী উল্লেখ করেন, এ দেশের মানুষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য রাজনৈতিকভাবে প্রস্তুত হয়ে ছিল। ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের পর মানুষ ২৬ মার্চ সকাল থেকেই সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করেছিল।
এরপর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তবে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫২ বছর পরও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক মহলের কাছে সেই গণহত্যার স্বীকৃতির দাবি করে আসছে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন