নির্বাচন কমিশন সব দলকে ভোটে আনার অগ্নিপরীক্ষায়

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের ওপর রাজনৈতিক দল আর সাধারণ মানুষের অনাস্থা বাড়ছে। আর এই আস্থাহীনতার কারণে নির্বাচনে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল অংশ নেবে কি না সেই প্রশ্ন বারবার ঘুরে ফিরে আসছে। ভোটের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়ায় কাজী আউয়াল কমিশনের অধীনে সর্বশেষ নির্বাচনগুলোয় ভোটার উপস্থিতিও কম। তাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার ও দলের আস্থা অর্জন এবং সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করাই এখন কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের বড় চ্যালেঞ্জ। দেশে গত দু’টি সাধারণ নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু হয়নি বলে বিভিন্ন ধরনের সমালোচনা রয়েছে। তাই আস্থা অর্জনের জন্য এরই মধ্যে ইভিএমর বদলে ব্যালটে ভোট নেয়ার ব্যবস্থায় ফিরে যেতে হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। ২০১৮ সালে রাতের ভোটের বদনাম ঘোচাতে, ভোটের দিনেই ব্যালট পেপার কেন্দ্রে পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞ ও সাবেক নির্বাচন কমিশনাররা বলছেন, আউয়াল কমিশন বেশ কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন শেষ করলেও তাদের মূল লক্ষ্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বর্তমান ইসি শুরু থেকেই উল্টো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার ব্যাপারে তাদের একরোখা মনোভাব ছিল। ইভিএম কেনা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করায় বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এবং বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে তাদের প্রতি অবিশ্বাস জন্ম নেয়। তাদের অধীনে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হওয়া নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করে।

ইসির ডাকা রাজনৈতিক সংলাপে বিএনপিসহ ৯টি রাজনৈতিক দল ও আমন্ত্রিত শিক্ষাবিদদের একটি বড় অংশ সাড়া দেয়নি। সংলাপে অংশ নেয়া সরকারি দল ছাড়া বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ইভিএমের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। কিন্তু বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে আউয়াল কমিশনের অন্তত দেড় শ’ আসনে ইভিএমে ভোট করার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। তাদের প্রতি যে আস্থার সঙ্কট দেখা দেয় তা কমে না এতটুকু। আস্থার সঙ্কটের কারণে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপ নির্বাচনে ভোট পড়ে ৩৮ শতাংশ। বিএনপির ছেড়ে দেয়া ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে ২৬.৪৬ শতাংশ ভোট পড়ে ইভিএমে। রাজশাহী ও সিলেট সিটি নির্বাচনে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটার ভোট দেয়। আর সর্বশেষ ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ভোটারই আসেননি। মোট ভোট পড়ে মাত্র ১১.৫১ শতাংশ। ফরিদপুর-২ আসনে ভোট পড়ে ২৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। অনেক কম ভোট পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে। মাত্র ১৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

আর জুনে অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হাতপাখার প্রার্থীর রক্তাক্ত হওয়াটা ‘আপেক্ষিক’ বলে মন্তব্য করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, ‘উনি (প্রার্থী) কি ইন্তেকাল করেছেন? না। ওনার কিন্তু রক্তক্ষরণটা দেখিনি। যতটা শুনেছি, ওনাকে কেউ পেছন দিক থেকে ঘুষি মেরেছে। ওনার বক্তব্যও শুনেছি, উনিও বলেছেন- ভোট বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না। আমাকে আক্রমণ করা হয়েছে। বরিশাল ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষে ঢাকায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি এসব কথা বলেছিলেন। তার এই মন্তব্য দেশজুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সিইসির মতো সাংবিধানিক পদের একজনের কাছ থেকে এমন মন্তব্য দেশবাসী প্রত্যাশা করেনি।

এদিকে, বর্তমান ইসির ঘোষিত রোড ম্যাপের প্রথম চ্যালেঞ্জই হলো, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা সৃষ্টি। কিন্তু দায়িত্ব পাওয়ার দেড় বছরেও রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ও বিশ^াস অর্জন করতে পারেনি কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) বেফাঁস ও দায়িত্বহীন বক্তব্য দলগুলোসহ দেশের মানুষ, সুশীলসমাজের কাছে ইসিকে বিতর্কিত করে তুলেছে।

নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসি পুলিশ প্রশাসনকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা, নির্বাচনের সময় হয়রানিমূলক মামলা বন্ধ করা এবং এজেন্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে আস্থায় ফিরতে পারে। কিন্তু ইদানীং তাদের যেসব কর্মপরিকল্পনা আসে তাতে এমন এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। এখনো ইসি তার নিজের ক্ষমতাই নিশ্চিত করতে পারেননি। এখনো অনেক সমস্যা সমাধানের জন্য তাকে সরকারের দিকেই তাদের তাকিয়ে থাকতে হবে। এরই মধ্যে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজেই বলেছেন ইভিএম অথবা কাগজের ব্যালটে নির্বাচন আয়োজন করা মোটেও বড় চ্যালেঞ্জ নয়। প্রধান দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কী করবে না, সেটাই মূল চ্যালেঞ্জ। তিনি আরো বলেন, বড় দলগুলো নির্বাচনে অংশ না নিলে নির্বাচনের লিগ্যালিটি (আইনগত ভিত্তি) নিয়ে কোনো সঙ্কট নেই। কিন্তু ল্যাজিটিম্যাসি (গ্রহণযোগ্যতা) শূন্যের কোঠায় নেমে যাবে।

আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমান ইসির করণীয় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো: শাহনেওয়াজ বলেন, ইসি একটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সাংবিধানিকভাবেই তাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। সংবিধানের বাইরে গিয়ে আলাদা করে চিন্তা করার কোনো অবকাশ নেই। তিনি বলেন, যেহেতু ডিসেম্বরের শেষ বা জানুয়ারির প্রথমেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে, তাই এখনই তাদের কর্মপদ্ধতির কার্যক্রম শুরু করতে হবে। তাদের হাতে সময় কম।

নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে সব দলকে অংশগ্রহণ করাতে ইসির করণীয় কী? জানতে চাইলে সাবেক এই কমিশনার বলেন, এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। রাজনৈতিক কারণেই দলগুলো নির্বাচনে না আসার ব্যাপারে অনড়। এখানে নির্বাচন কমিশনের কোনো করণীয় নেই। তবে দলগুলো যে শঙ্কা প্রকাশ করছে নির্বাচন কমিশন ঠিকঠাক নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে না। তাই এই ব্যাপারে ইসির উচিত নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার ব্যাপারে তাদের যত ধরনের কর্মকাণ্ড আছে তা সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে পরিচালনা করা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে তারা সেদিকেই এগোচ্ছে।

নির্বাচন বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আগের দু’টি সাধারণ নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু হয়নি। সেই নির্বাচনের পর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন কমিশনের প্রতি একটা অনাস্থা ও অবিশ্বাস কাজ করছে। যে কারণে নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণ আস্থা হারিয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা প্রশ্ন ওঠে। বিনা ভোটে ১৫৪ জন নির্বাচিত হন। গত দেড় বছরের ক্ষমতায় বর্তমান ইসি এমন কিছু করতে পারেনি, যা মানুষের সেই ধারণা পরিবর্তন করবে। আস্থা ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে তাদের দেড় বছরে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন এমন কিছু করতে পারেনি, যা মানুষের সেই ধারণা পরিবর্তন করবে। তিনি আরো বলেন, আমি মনে করি ইসির উচিত ক্ষমতাসীন দলকে পরিষ্কারভাবে বলা যে, বর্তমান অবস্থায় নির্বাচন করা সম্ভব নয়। কারণ এতে সাংবিধানিক ম্যান্ডেট অর্জন হবে না। ভোটাররা কেন ভোটে আসছে না এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ইসির নিজের কর্মকাণ্ডের কারণে ভোটাররা উৎসাহ হারিয়েছে। তাদের উচিত সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনায় বাধ্য করা।