জাতীয় পার্টি আবারও বিভক্ত
কিছুদিন ধরেই সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে (জাপা) যে অস্থিরতা চলছিল, হঠাৎ করেই তা বিদ্রোহে রূপ নিয়েছে। দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে দায়িত্ব থেকে ‘অব্যাহতি’ দিয়ে নিজেকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা দিয়েছেন দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ। এর ফলে কার্যত জাপা আবারও দুই ভাগে বিভক্ত হলো।
গতকাল রবিবার গুলশানের নিজ বাসভবনে এক মতবিনিময়সভায় রওশন এরশাদ এই ঘোষণা দেন।তিনি জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী মামুনুর রশীদকে মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছেন।
রওশন এরশাদ বলেন, ‘দলের গঠনতন্ত্রের ২০-এর ১ ধারা অনুযায়ী জি এম কাদের ও চুন্নুকে অব্যাহতি প্রদান করলাম।’
এর প্রতিক্রিয়ায় গতকাল বনানী কার্যালয়ে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের বলেন, এসবের কোনো মূল্য নেই। আগেও রওশন এরশাদ দুইবার নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছিলেন।তাই তাঁর বক্তব্য আমলে নিচ্ছেন না তাঁরা।
রওশন এরশাদের সংবাদ সম্মেলনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জাপাকে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। জি এম কাদের হয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা। মতবিনিময়সভায় জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত, অব্যাহতিপ্রাপ্ত, স্বেচ্ছায় পদত্যাগকারী নেতাকর্মীরা অংশ নেন।
গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টি থেকে অব্যাহতি পাওয়া প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত এবং রওশন এরশাদের মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশীদ। এ ছাড়া সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য দেলোয়ার হোসেন খান, সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম সারওয়ার মিলন, জিয়াউল হক মৃধা, ভাইস চেয়ারম্যান আমানত হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, নুরুল হক, খোরশেদ আলম, ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি ইয়াহিয়া চৌধুরী, জাতীয় ছাত্র সমাজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রফিকুল হক, এরশাদপুত্র ও দলের যুগ্ম মহাসচিব রাহগীর আল মাহি এরশাদ (সাদ এরশাদ) ছিলেন।
তবে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। ফলে এই নেতৃত্ব নিয়ে রওশনের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী অংশ কত দূর এগোতে পারবে তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে। দলের নেতারা জানিয়েছেন, আপাতত তাঁদের মূল পরিকল্পনা হচ্ছে দ্রুত সম্মেলন করে নেতৃত্ব নির্বাচিত করা।
দলের নেতাকর্মীরা এও বলছেন, জাপার অভ্যন্তরে জি এম কাদের অজনপ্রিয় হয়ে পড়ছেন। সরকারঘেঁষা মনোভাব তাঁকে বিতর্কের মুখে ফেলেছে। ফলে তাঁর নেতৃত্ব ভবিষ্যতে আরো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বলে তাঁদের ধারণা।
মতবিনিময়সভায় রওশন এরশাদ আরো বলেন, ‘জাতীয় পার্টি ক্ষতিগ্রস্ত হোক তা মেনে নিতে পারি না। জাপা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। জি এম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নু দলকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন।’
পার্টির অন্যান্য পদে যাঁরা আছেন, তাঁদের স্বপদে বহাল রেখে পার্টির যেসব নেতাকে জি এম কাদেরের সিদ্ধান্তে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে কিংবা বহিষ্কার করা হয়েছে এবং যাঁদের পার্টির কমিটির বাইরে রাখা হয়েছিল, তাঁদের আগের পদে ‘পুনর্বহালের’ ঘোষণা দেন রওশন। তিনি বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে পার্টির জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করবেন তিনি।
রওশন বলেন, জাতীয় নিবার্চনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৭টি আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে ২৬টি আসনে সমঝোতা করা হয়েছে। আসন সমঝোতার পরও জনসমক্ষে তা অস্বীকার করে দেশবাসী ও পার্টির মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে পার্টিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে।
রওশনের কাছ থেকে মহাসচিবের দায়িত্ব পাওয়া কাজী মামুনুর রশিদ মতবিনিময়সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ফেব্রুয়ারি অথবা মার্চের প্রথম সপ্তাহে দলের সম্মেলন হবে।
জি এম কাদের জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছোট ভাই। এরশাদপত্নী রওশন এরশাদের সঙ্গে জি এম কাদেরের রাজনৈতিক টানাপড়েন অনেক আগে থেকে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁদের মধ্যে কোন্দল আরো বাড়ে। নিজ অনুসারীদের দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ায় রওশন এরশাদ এবং তাঁর ছেলে রাহগীর আল মাহি এরশাদ নির্বাচনে অংশই নেননি। আর নির্বাচনে ভরাডুবির পর দলের একাংশ জি এম কাদেরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
নির্বাচনের পর থেকে দলের বিক্ষুব্ধরা বিদ্রোহ শুরু করেন। ভোটের পাঁচ দিনের মাথায় দলের কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভরায়কে দলের সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাঁরা দুজনই রওশন এরশাদ পন্থী হিসেবে পরিচিত। এর পরই জি এম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরাতে রওশনপন্থী ও দলের বিদ্রোহীদের মধ্যে ঐক্য তৈরি হয়। এরই অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার জাপার ঢাকা মহানগরের ৯ শতাধিক নেতাকর্মী একযোগে দল থেকে পদত্যাগ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে মুজিবুল হক চুন্নু আরো বলেন, ‘চেয়ারম্যান-মহাসচিবকে বাদ দিয়েছেন এটা এ নিয়ে তৃতীয়বার। দুইবার নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে বাদ দিয়েছিলেন। পরে আবার প্রত্যাহার করেছিলেন এই বলে যে উনার ঘোষণাটা ঠিক না।’
রওশনের ঘোষণা অগঠনতান্ত্রিক আখ্যা দিয়ে চুন্নু বলেন, ‘জাপার গঠনতন্ত্রে এমন কোনো ধারা নেই, যাতে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক কাউকে বাদ দেবেন। এই ঘোষণার কোনো ভিত্তি নেই। এ ধরনের কোনো ক্ষমতা রওশন এরশাদের নেই। গঠনতন্ত্রের বাইরে যেকোনো ব্যক্তি মনের মাধুরী মিশিয়ে যেকোনো কথা বলতেই পারে, এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। তাদের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।’
রওশন এরশাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না জানিয়ে চুন্নু বলেন, ‘তিনি জাপার প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদের স্ত্রী। শ্রদ্ধার কারণেই তাঁকে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হয়, যা আলংকারিক পদ। এ পদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। আর যাঁরা তার সঙ্গে আছেন তাঁরা দলের কেউ না।’
এ বিষয়ে জাপার দুর্গ বলে পরিচিত এইচ এম এরশাদের বাড়ি রংপুরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সেখানকার সাধারণ সমর্থকদের মতে, দলের দুই প্রধান নেতার মধ্যে দ্বন্দ্ব জাপায় সংকট তৈরি করেছে। তবে স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতারা মনে করেন, জি এম কাদেরকে অব্যাহতি দেওয়ার এখতিয়ার রওশন এরশাদের নেই।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন