এমপি আনারের খণ্ডিত লাশ নিয়ে বের হন আমানুল্লাহ-জিহাদ
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনসের একটি ফ্ল্যাটে যাওয়ার পর তিনি আর জীবিত ফিরতে পারেননি। বের হয়েছেন খণ্ড খণ্ড লাশ হয়ে ট্রলি আর পলিথিন ব্যাগে। পুরো কিলিং মিশনে সবার সামনে ছিলেন শিমুল ভূঁইয়া ওরফে সৈয়দ আমানুল্লাহ। হত্যার পর তার হাত-পাসহ শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টুকরো টুকরো করে আলাদা করে হত্যাকারীরা।
৫৮ সেকেন্ডের একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এসেছে জাগো নিউজের হাতে। ফুটেজটিতে দেখা যায়, ভারতীয় সময় ১৪ মে বিকেল ৫টা ১১ মিনিটের দিকে দুজন ব্যক্তি একটি পেস্ট কালারের ট্রলি ব্যাগ ও তিন থেকে চারটি পলিথিন ব্যাগে আনারের মরদেহ গুম করার জন্য লিফটে উঠছেন।
তিন আসামিকে দশ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন
ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, সঞ্জীবা গার্ডেনসের ফ্ল্যাট থেকে যে দুজন বের হয়েছেন তারা হলেন- শিমুল ভূঁইয়া ওরফে সৈয়দ আমানুল্লাহ ও সিয়াম ওরফে কসাই জিহাদ। সিসি ক্যামেরায় যা দেখা গেছে তা স্বীকারও করেছেন ডিবির হাতে গ্রেফতার আমানুল্লাহ। অন্যদিকে ভারতীয় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন কসাই জিহাদ।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবির একজন কর্মকর্তারা জাগো নিউজকে জানান, এমপি আনারকে হত্যার বিস্তারিত বর্ণনা শুনে তারা নিজেরাই আঁতকে উঠেন। তার পুলিশি ক্যারিয়ারে অনেক খুনের ঘটনার বর্ণনা শুনেছেন, কিন্তু এত নৃশংস বর্ণনা কখনোই শোনেননি।
আনোয়ারুল আজীমের লাশের সন্ধানে সিআইডির তল্লাশি
জিজ্ঞাসাবাদে শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ জানিয়েছেন, কীভাবে এমপি আনারকে বালিশচাপা দিয়ে হত্যার পর হাত-পাসহ শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আলাদা করা হয়। যেন কোনোভাবেই আনারের চেহারা দেখে কেউ পরিচয় শনাক্ত করতে না পারে, সেজন্যই খুনিরা এ পরিকল্পনা করে। এরপর ট্রলি ও ব্যাগে করে খণ্ড খণ্ড লাশ বের করে নেওয়া হয়।
লাশ ফেলা হয় হাতিশালা বর্জ্য খালে:
আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভুঁইয়া নামে সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া আসামি ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, আনোয়ারুল আজীম আনারকে সঞ্জীবা গার্ডেনের ফ্ল্যাটে হত্যা করা হয়। হত্যার পর শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে আলাদা করা হয়। এরপর একটি ট্রলি ও তিন-চারটি পলিথিন ব্যাগে করে ১৪ মে বিকেল ৫টা ১১ মিনিটের দিকে সে সব টুকরো বের করা হয়। এরপর এগুলো ফেলে দেওয়া হয় কলকাতার হাতিশালা বর্জ্য খালে।
এখনো লাশ পায়নি ভারতীয় পুলিশ:
আমানের স্বীকারোক্তির পর ভারতীয় পুলিশ ২৩ মে রাতে হাতিশালা বর্জ্য খালে তল্লাশি চালায়। তবে অন্ধকার হওয়ায় সেদিন মরদেহ খুঁজে পায়নি পুলিশ। পরেরদিন ২৪ মে আবারও খণ্ড লাশের সন্ধান শুরু করে ভারতীয় পুলিশ। ডিবির দাবি, যেহেতু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি বেশ কয়েকজন আসামি গ্রেফতার রয়েছেন এবং তথ্য দিয়েছেন সেহেতু লাশের সন্ধান মিলবে।
শুরুতে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন আমান:
এমপি আনারকে হত্যার জন্য ভাড়া করা হয় খুলনা অঞ্চলের কুখ্যাত সন্ত্রাসী শিমুল ভূঁইয়াকে (আমান)। তিনি চরমপন্থি সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম শীর্ষ নেতা। এ ঘটনায় ঢাকায় ধরা পড়ার পর পুলিশের কাছে শিমুল ভূঁইয়া নিজেকে সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান নামে পরিচয় দেন এবং তিনি এমপি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবি করেন। তবে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের মুখে এক পর্যায়ে আমান স্বীকার করেন তিনিই আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভুঁইয়া।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি আমানুল্লাহ নামেই পাসপোর্ট বানিয়েছেন, সেই পাসপোর্টে তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন। ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে পাসপোর্টটি করা হয়েছিল। পাসপোর্ট করতে একই নামে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্রও (এনআইডি) তৈরি করেন। কীভাবে তিনি শিমুল ভূঁইয়া থেকে আমানুল্লাহ হলেন এবং ভুয়া পাসপোর্ট ও এনআইডি তৈরি করলেন, এখন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন গোয়েন্দারা।
কসাই জিহাদ দিলেন হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা:
ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার গ্রেফতারের পর জিহাদ জিজ্ঞাসাবাদের মুখে এমপি আনার হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা দেন।
সুত্র জানিয়েছেন, সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে জিহাদ বলেছেন, প্রথমে আনারকে শ্বাসরোধে খুন করা হয়। তারপর দেহ টুকরো টুকরো করা হয়। হাড় এবং মাংস আলাদা করা হয়। চামড়া ছাড়িয়ে তাতে হলুদ মাখান অভিযুক্তরা, যাতে বাইরে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলা যায়, রান্না করার জন্য মাংস নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার গ্রেফতারের পর জিহাদকে একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আনারকে খুনের পর সেখানেই দেহাংশ ফেলা হয়েছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে উঠে এসেছে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে সেখান থেকে কোনো দেহাংশ মেলেনি।
২৪ বছর বয়সী জিহাদ হাওলাদার বাংলাদেশের খুলনার বাসিন্দা। অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশ করেছিলেন তিনি। আনারকে খুনের প্রায় দুই মাস আগে জিহাদকে মুম্বাই থেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন হত্যাকারীরা।
হত্যার এক মাস আগে ফয়সাল-মোস্তাফিজুরের পাসপোর্ট:
গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টরা জানান, হত্যাকাণ্ডে জড়িত ফয়সাল ও মোস্তাফিজুরের দুটি পাসপোর্টই চলতি বছরের ৮ এপ্রিল ঢাকার বিভাগীয় পাসপোর্ট কার্যালয় থেকে ইস্যু করা হয়। পাসপোর্টে ফয়সালের স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে খুলনার ফুলতলা থানার অলকা গ্রাম এবং মোস্তাফিজুরের স্থায়ী ঠিকানা খুলনার ফুলতলার যুগনীপাশা গ্রাম উল্লেখ করা হয়েছে। আমান ওরফে শিমুল ভুঁইয়া মোস্তাফিজুর ও ফয়সালকে পাসপোর্ট বানিয়ে দেন। তবে দুজনেরই বর্তমান ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ঢাকার ক-৩২/১২ নদ্দা।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এমপি আনারকে কলকাতায় হত্যার পরিকল্পনা সাজিয়েই মোস্তাফিজ ও ফয়সালের পাসপোর্ট করানো হয়। ভারতীয় ভিসা সংগ্রহ করে ১১ মে কলকাতায় প্রবেশ করেন তারা। হত্যাকাণ্ড শেষে ১৭ মে মোস্তাফিজ ও ১৮ মে ফয়সাল দেশে ফিরে আসেন।
সোনার অবৈধ ব্যবসার আলোচনা করতেই কলকাতায় যান এমপি আনার:
এমপি আনোয়ারুল আজীমকে হত্যার মূল পরিকল্পনায় তারই বাল্যবন্ধু এবং আমেরিকা প্রবাসী আক্তারুজ্জামান শাহীন। শাহীনের সঙ্গে আজীমের অবৈধ সোনা ব্যবসা রয়েছে। দুবাই কেন্দ্রিক স্বর্ণের ব্যবসায় শাহীনের বিনিয়োগ রয়েছে। দুবাই থেকে আসা সোনা আজীম ভারতে বিভিন্নভাবে সরবরাহ করতেন। আনারের কলকাতার ব্যবসায়ী বন্ধু গৌতম বিশ্বাস সেই সোনার ক্রেতা ছিলেন।
সূত্রটি জানিয়েছে, কলকাতায় চিকিৎসার নাম করে আনার সেখানে গেলেও, আসলে তিনি সেখানে কোনো চিকিৎসা করাননি। এই কথা বলে তিনি কলকাতা যান। শাহীনের সঙ্গে তার সোনার ব্যবসা নিয়েই দ্বন্দ্ব হয়। এই দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করেই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন