কলকাতার নায়িকাদের টার্গেট বাংলাদেশ, ভরসা শাকিব খান

উত্তম-সৌমিত্র-মিঠুনদের পর প্রসেনজিতের একঘেয়েমি চরিত্র আর অভিনয়ে কলকাতার চলচ্চিত্র অনেকটা ডিমেতালে পথ চলেছে দীর্ঘ একটা সময়। এক পর্যায়ে জিৎ, দেব, সোহম, অঙ্কুশ, আবির, স্বস্তিকা, শ্রাবন্তী, কোয়েল মল্লিক, শুভশ্রীরা নতুন হাওয়া দিলেন টালিগঞ্জের সিনেমার পালে। এলো বাণিজ্যিক সিনেমার গল্পের বদল, নির্মাণের ব্যতিক্রম ভাবনা। ছবির বাজেট বৃদ্ধিতে সিনেমায় দেখা গেল চাকচিক্য।

এলো ব্যবসায়িক সফলতাও। তবে বেদনা হয়ে বাজলো তামিল আর বলিউডের ছবির নকল করার ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা। একটা পরিবর্তন চাইছিল টালিগঞ্জ। অবশেষে নতুন সুর তুলে এলেন বেশ ক’জন ম্যাজিশিয়ান নির্মাতা। সৃজিত মুখার্জি, কৌশিক গাঙ্গুলি, কমলেশ্বর, অরিন্দম শীল, নন্দিতা দাসের মতো নির্মাতাদের হাত ধরে বদলে গেল কলকাতার চলচ্চিত্র শিল্প। মৌলিক গল্প, নির্মাণের মুন্সিয়ানা, ফ্রেম, লাইট, গল্প বলার স্মার্টনিটিতে আবারও হলে ফিরলো রুচিশীল দর্শক।

নিজেদের আমূল বদলে নিলেন শাশ্বত চ্যাটার্জি, প্রসেনজিৎ, যিশু সেনগুপ্ত, স্বস্তিকা, কোয়েল মল্লিক, দেব, পাওলি দাম, মিমিরা। রজতাভ দত্ত, খরাজ মুখার্জির মতো অভিনেতারাও একটু ভারি চরিত্রে নিজেদের মানিয়ে নিলেন। রাজ চক্রবর্তী, অশোক পাতিরা কপিতে মেতে থাকলেও চাকচিক্য আর সুড়সুড়ি মাখানো কমেডি সিনেমা উপহার দিতে পারছেন, তবে নিয়ন্ত্রণ রয়ে গেল গল্প ও চরিত্র প্রধান সিনেমার নির্মাতাদের হাতেই।

কথিত বাণিজ্যিক সিনেমা নির্মাণ কমে যাওয়ায় কমে গেল অঙ্কুশ, ওম, সোহমদের মতো কথিত নায়কসুলভ অভিনেতার চাদিহা। কমেছে ছোট কাপড় পড়ে নাচা নায়িকাদের চাহিদাও। সেই তালিকায় রয়েছেন শ্রাবন্তী, শুভশ্রী, সায়ন্তিকা, নুসরাত জাহানের মতো নায়িকরা। তাদের কেউ কেউ চেষ্টা করেছেন অবশ্য নিজেদের চরিত্র প্রধান ছবিতে থিতু করতে। তবে সাফল্য তেমন করে পাননি। বাধ্য হয়ে এখনো মশলাদার সিনেমাকেই আঁকড়ে ধরে আছেন।

তবে এই মেজাজের সিনেমা কমে যাওয়াতে ভুগছেন তারা। হাতে ছবি নেই। এসকে মুভিজ এই ধারার সিনেমায় কিছু টাকা লগ্নি করলেও শ্রী ভেঙ্কটেশের মতো প্রতিষ্ঠান নতুন বছরে প্রায় ৯৫ ভাগ বিনিয়োগই করতে যাচ্ছে ভিন্ন মেজাজের সিনেমার পেছনে। স্বাভাবিকভাবেই কলকাতায় নায়িকাদের বেকারত্ব বাড়ছে।

সেই হুমকিতেই হয়তো এ নায়িকাদের নজরে রয়েছে বাংলাদেশের সিনেমার বাজার। আর সেই বাজারে তাদের তুরুপের তাস এপার বাংলার সিনেমার মশলদার সিনেমার সেরা নায়ক শাকিব খানের। এরই মধ্যে শ্রাবন্তী ও শুভশ্রী প্রমাণ পেয়েছেন শাকিবের নায়িকা হয়ে বাংলাদেশের বাজারে তারা সফল হতে পারবেন। আর সেই প্রমাণের অপেক্ষায় রয়েছে সায়ন্তিকা ও নুসরাত জাহান।

২০১৬ সালে এসকে মুভিজ ও বাংলাদেশের জাজ মাল্টিমিডিয়ার হাত ধরে জুটি বাঁধেন শাকিব খান ও শ্রাবন্তী। ছবির নাম ‘শিকারী’। এ ছবিটি মুক্তি পেলে বাংলাদেশ দারুণ ব্যবসা করতে সমর্থ হয়। এর পরের বছর একই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে জুটি বাঁধেন শাকিব খান ও শুভশ্রী। তাদের ছবিটির নাম ছিলো ‘নবাব’। গেল বছরের কোরবানী ঈদে মুক্তি পাওয়া ছবিটি নবাবী করেছে সিনেমা হলে।

তবে গেল বছর মুক্তি পাওয়া ‘সত্তা’ নামের ছবিটিতে কলকাতার পাওলি দামের সঙ্গে জুটি বেঁধে সুবিধা করতে পারেননি শাকিব। কিন্তু নিজের ব্যতিক্রমী অভিনয়ের স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন।

এবার অপেক্ষা রয়েছে শাকিবকে নিয়ে সায়ন্তিকা ও নুসরাত জাহানের ছবি ‘মাস্ক’র মুক্তি। কলকাতার সবেচেয়ে বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের ব্যানারে একক প্রযোজনাতেই ছবিটি নির্মিত হবে বাংলাদেশে। সাফটায় ছবিটি মুক্তি পাবে বাংলাদেশেও। এ ছবিটি নিয়ে আশাবাদী কলকাতার দুই নায়িকা। তারাও বুক বেঁধেছেন শ্রাবন্তী ও শুভশ্রীর মতোই সফল হবেন বাংলাদেশে, সেই আশাতে।

এর বাইরে শাকিব আরও দুটি সিনেমাতে কাজ করছেন শুভশ্রী ও সায়ন্তিকাকে নিয়ে। জয়দীপ মুখার্জি পরিচালিত ‘চালবাজে’ শাকিবের সঙ্গে রোমান্টিক নায়িকা হিসেবে দেখা যাবে শুভশ্রীকে। আর সায়ন্তিকার সঙ্গে শাকিবকে নিয়ে কলকাতার পরিচালক রাজিব নতুন একটি ছবির উদ্যোগ নিয়েছিলেন গতবছর। তবে এর কোনো আপডেট আর মেলেনি।

বলে রাখা ভালো কলকাতার নায়িকা হিসেবে শাকিবের বিপরীতে সর্বপ্রথম কাজ করেন স্বস্তিকা মুখার্জি। এফ আই মানিক পরিচালিত ছবিটি বাংলাদেশে মুক্তি পায় ‘সবার উপরে তুমি’ নামে ১৩ নভেম্বর ২০০৯ সালে। আর ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১০ সালে কলকাতায় মুক্তি পায় ‘আমার ভাই আমার বোন’ নাম নিয়ে। ছবিটি নির্মিত হয়েছিলো যৌথ প্রযোজনায়।

এদিকে চলচ্চিত্রপাড়ার আলোচনা, কলকাতায় পরিবর্তনের সঙ্গে তাল না মেলাতে পেরে বেকার হতে যাওয়া বেশ ক’জন নায়িকাদের টার্গেট এখন বাংলাদেশের সিনেমা বাজার। এখানেই তারা জমিয়ে তুলতে চাইছেন নিজেদের ক্যারিয়ার। অভিষেকের জন্য তারা বেছে নিচ্ছেন শাকিব খানকে। এজন্য তারা নিয়মিতই ধরনা দিচ্ছেন কলকাতার বিভিন্ন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানে। কারো কারো টার্গেটে রয়েছে বাংলাদেশের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়াও। কেননা, ওই প্রতিষ্ঠানটির হাত ধরেই বাংলাদেশে শুভযাত্রা করেছেন শ্রাবন্তী ও শুভশ্রী। নায়িকাদের পাশাপাশি জিৎ, ওম, অঙ্কুশের মতো নায়কেরাও এই প্রতিষ্ঠানের প্রযোজনায় বাংলাদেশের সিনেমা হলে হাজির হয়েছেন।

এইসব নায়িকাদের জন্য শাপে বর হয়েছে শাকিবের অতি মাত্রায় কলকাতা প্রীতি। নানা কারণেই নিজের ইন্ডাস্ট্রির উপর বিরক্ত বা আশা হারিয়েছেন শাকিব খান। তিনি এখন পুরোদমেই কলকাতামুখী। বাংলাদেশি সিনেমা নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না। নতুন ছবির প্রস্তাব পেলেই কলকাতার নায়িকাদের নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন পরিচালকদের। বাংলাদেশের সংগীত পরিচালকের প্রতিও আস্থা নেই তার। সম্প্রতি বাংলাদেশি সংগীত পরিচালকদের বাদ দিয়ে কলকাতার মানুষকে দিয়ে গান করানো নিয়ে বেশ সমালোচিত হয়েছেন শাকিব।

শুধু তাই নয়, শুটিং না থাকলেও পড়ে থাকেন কলকাতায়। নেচে-গেয়ে বেড়ান পশ্চিমবঙ্গের স্টে শোগুলোতে। সেখানে তিনি সরাসরি কলকাতায় দর্শক তৈরিরও চেষ্টা করছেন।

তবে হতাশার ব্যাপার হলো, শাকিবকে দিয়ে বাংলাদেশের বাজারে কলকাতার নায়িকারা সাফল্য পেলেও শাকিব কিন্তু এখন অব্দি কিছু আলোচনা তৈরি করা ছাড়া কলকাতায় নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি। তার ‘নবাব’ ছবিটি কলকাতায় বেশ লম্বা একটি তালিকা নিয়ে সিনেমা হলে গিয়েছিলো। কিন্তু সেখানকার সেল রিপোর্টে মোটেও সন্তুষ্ট ছিলো না ছবিটির কলকাতার প্রযোজক এসকে মুভিজ। যদিও বরাবরই প্রতিষ্ঠানটির কৌশলী কর্তৃপক্ষ তাদের ছবিগুলোকে ব্যবসা সফল বলে দাবি করেন। তবে ‘নবাব’র ব্যর্থতা প্রমাণ দেয় ছবিটির মুক্তির পর শাকিবকে নিয়ে তাদের নতুন কোনো ঘোষণা না আসায়।

এও শোনা গেছে, সিনেমা ফ্লপ হবার চেয়ে এসকে মুভিজের হাত ধরে কলকাতার বাজারে প্রবেশ করা শাকিব হুট করেই ভেঙ্কটেশের ছবিতে নায়ক হওয়ায় তার উপর বিশ্বাস হারিয়েছে এসকে মুভিজ। তাই তাকে নিয়ে আর নতুন ছবির ঘোষণা দেয়নি এসকে মুভিজ। নিরব রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশি পার্টনার জাজ মাল্টিমিডিয়াও।

তবে কলকাতার বাজারে নজর রেখে জানা যায়, মশলাদার সিনেমায় একটা বলয় শাকিব তৈরি করতে পারলেও গল্প প্রধান সিনেমায় নিয়ন্ত্রিত বাজারে খাবি খাচ্ছেন। যেখানে বাংলাদেশি অভিনেত্রী জয়া আহসানকে নিয়ে মেতে উঠেছে সমগ্র কলকাতার সিনেমা সেখানে শাকিবের নাম শোনা যায় না কোথাও। বাংলাদেশে ওপারের সিনেমার বাজার তৈরিতে ভায়া হিসেবেই তাকে দেখা হচ্ছে বলে আলোচনা টালিগঞ্জে। তবে শাকিব চেষ্টা করে চলেছেন আপন আলোয় জ্বলে উঠতে।