খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সমাজ-জাতি রক্ষায় যুব সমাজের অগ্রণী ভূমিকা শীর্ষক আলোচনা সভা
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দীঘিনালা উপজেলায় “সমাজ-জাতি রক্ষায় যুব সমাজের অগ্রণী ভূমিকা” শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার (২১শে জুন) দুপুর ১:৩০টার সময় গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম দীঘিনালা উপজেলা শাখা এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।
“তারুণ্যের মহাশক্তিকে মহান লক্ষ্যে চালিত করো” শ্লোগানে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের দীঘিনালা উপজেলা সভাপতি জ্ঞান প্রসাদ চাকমা ও সঞ্চালনা করেন সুজন চাকমা।
সভায় অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন দীঘিনালা উপজেলার বিশিষ্ট সমাজ সেবক আনন্দ মোহন চাকমা, ইউপিডিএফ সংগঠক সুজয় চাকমা, ইউপিডিএফ সংগঠক দীপন চাকমা ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ সাধারণ সম্পাদক সমর চাকমা।
সভায় ইউপিডিএফ সংগঠক সুজয় চাকমা বলেন, বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার দিকে তাকালে প্রায়ই অবক্ষয়ের চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। দোকানে, রাস্তা-ঘাটে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মদ, জুয়া, সিগারেটসহ বিভিন্ন মাদকের আড্ডা চলে। আজকাল মোবাইলে গেম ও জুয়া খেলে অনেকে সময় পার করায়। কিন্তু সমাজ বা জাতির কোন বৃহত্তর কাজে তাদের আহ্বান করলে তারা এগিয়ে আসে না। এটা আমাদের সমাজ ও জাতির জন্য কখনো মঙ্গলজনক নয়। আমাদের ছাত্র-যুব সমাজকে এই অবক্ষয় থেকে বেরিয়ে এসে জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হাল ধরতে হবে।
তিনি বলেন, একটি জাতি ও সমাজ এগিয়ে নেয়ার জন্য ছাত্র-যুব সমাজের ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের সকলের মধ্যে জাতীয়তাবোধের চেতনা জাগ্রত করতে হবে। ছাত্র-যুব সমাজের মধ্যে যদি জাতীয়তাবোধের চেতনা সৃষ্টি না হয় তাহলে জাতির ভবিষ্যত অন্ধকারে পতিত হবে। সুতরাং তারুণ্যের শক্তিকে খারাপ কাজে ব্যবহার না করে জাতির কল্যাণে চালিত করতে হবে।
তিনি সামাজিক অবক্ষয়সহ সমাজে অন্যায্য কর্মকান্ড রোধকল্পে সমাজ ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও সমাজসেবকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
বিশিষ্ট সমাজ সেবক আনন্দ মোহন চাকমা বলেন, আজকে আলোচনা সভা খুবই যুগোপযোগী। প্রতিটি এলাকায় এ ধরনের আলোচনা হওয়া দরকার।
তিনি বলেন, আমরা সরকারের গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছি। সমতলে মাদকের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে সোচ্চার হতে দেখা যায়, কিন্তু পাহাড়ে এ বিষয়ে সরকার বা প্রশাসনের কোন মাথা ব্যথা নেই। আমরা সরকারের নানা ফাঁদে পড়ে সামাজিক ও জাতিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, আমাদের পূর্ব পুরুষরা অনেক সাহসিকতার সাাথে জাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য আন্দোলন করে গেছেন। আজকে নিজেদের মধ্যেকার ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের কারণে সমাজে আন্দোলন নিয়ে বিরূপ প্রভাব পড়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, যারা সমাজের দায়িত্ব পালন করেন, আ লিক রাজনীতির কারণে তাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। এক পক্ষ ডাকলে আরেক পক্ষের প্রশ্নের মুখোমুখি ও রোষানলে পড়ার ভয় থাকে। তাই এ ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত পরিহার করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য সবাইকে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। আমরা ঐক্যবদ্ধ হলে জাতির দুর্দিন নিশ্চয় একদিন কেটে যাবে।
মাদকের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের পাহাড়ি সমাজে বিবাহ, জম্মদিন, হজোই পানি, স্কুলে বিদায় অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মদের আয়োজন করা হয়ে থাকে। ফলে সমাজে এর কুপ্রভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর থেকে যুব সমাজও মুক্ত হতে পারছে না। তাই এ ব্যাপারে আমাদের যুব সমাজকে গভীরভাবে ভাবতে হবে এবং সমাজ উন্নতি কল্পে যুবকদেরকে আরো সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
পিসিপি নেতা সমর চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ছাত্র-যুবকরা এক সময় সুশৃঙ্খল ছিলো। কিন্তু জাতির ক্রান্তিলগ্নে বর্তমান যুব সমাজ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে আছে। যারা শাসকের ফাঁদে পড়েছে তারাই আজ আমাদের ছাত্র-যুবকদের রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, এক সময় চীনে সাম্রাজ্যবাদী শাসক-শোষকরা আফিম খাইয়ে সেখানকার ছাত্র-যুবকদেরকে মাদকাসক্ত করে রাখার কৌশল নিলে তার বিরুদ্ধে চীনের সচেতন জনগণ আন্দোলন করেছিল। আজ আমাদের সমাজে একই কায়দায় মাদক ঢুকিয়ে দিয়ে যুব শক্তিকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা চলছে। এর বিরুদ্ধে আমাদেরকেও রুখে দাঁড়াতে হবে।
তিনি বলেন, একটা কথা আছে “প্রবীণে বুদ্ধি, যুবকে শক্তি”। সমাজের যারা নেতৃত্ব দেন তারা এলাকায় জনসাধারণ বা যুব সমাজকে ভালো পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু আজকাল দেখা যায়, আমাদের সমাজে সকলে মিলে মদ, জুয়ার আসর বসিয়ে সময় কাটায়। ফলে সমাজের অধিকাংশ যুবক মদ, ইয়াবা. গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে। এসব সামাজিক অবক্ষয়মূলক কর্মকান্ড বন্ধ হওয়া দরকার।
ছাত্র-যুব সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সমর চাকমা বলেন, আমাদের জাতির অস্তিত্ব রক্ষা ও ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য ছাত্র-যুব সমাজকে সাহসিকতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে। আজকে যদি আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকিয়ে দেখি তাহলে দেখতে পাই যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকরা ভালোভাবে শিক্ষা দান করেন না। ছাত্রদেরকে নীতি নৈতিকতা ও জাতীয়তাবোধের শিক্ষা দেন না। জাতি হিসেবে টিকে থাকার লড়াইয়ে আমাদের সবাইকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। মদ, জুয়ার আসরে সময় পার না করে জাতির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে ছাত্র-যুব সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, সামনে ৩০শে জুন আসছে। এই দিনটি পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে বসবাসরত সংখ্যালঘু ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিসত্তাসমূহের জন্য একটি কালো দিন। ২০১১সালের এই দিন ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার জাতীয় সংসদের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস করে জাতিসত্তাগুলোর ওপর বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দিয়েছিল। এই উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন করতে হবে।
সভার সভাপতি জ্ঞান প্রসাদ বলেন, দীঘিনালায় বর্তমানে প্রায় সময় ঝিরি ঝর্ণায় বনভোজনের নামে মদ পানের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়ে থাকে। অনেকে গোপনে মাদক ব্যবসা করে থাকেন। বিভিন্ন অসাধু ব্যবসায়ি ভারত হতে চোরাকারবারি করে মদ, গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল নিয়ে আসে। গত (১৫ই জুন) গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের উদ্যোগে ৪কেজি গাঁজা জব্দ করা হয়। সেগুলো আজকে পুড়িয়ে ফেলা হবে। যুব ফোরাম মাদকবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যাবে বলে তিনি জানান।
তিনি সবাইকে মাদক সেবন, মাদক ব্যবসাসহ সামাজিক অবক্ষয়মূলক কর্মকান্ড পরিহার করে উন্নত সমাজ গঠন ও জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
আলোচনা সভা শেষে সমাজসেবক আনন্দ মোহন চাকমাসহ উপস্থিত লোকজনের সম্মুখে জব্দকৃত গাঁজাগুলো পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন