খাগড়াছড়ির রামগড়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত জটিলতায় থমকে আছে স্থলবন্দরের কাজ
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড় উপজেলায় বাংলাদেশ-ভারতে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত সংক্রান্ত জটিলতায় দীর্ঘ ছয় মাস যাবত থমকে আছে রামগড়-সাব্রুম স্থলবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ।
সীমান্তর ১৫০গজের মধ্যে অধিগ্রহণকৃত রামগড় স্থলবন্দরে জায়গায় স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না থাকায় সে দেশের সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিএসএফ বাঁধা দিয়ে কাজ বন্ধ করে দেয়। ফলে অবকাঠামো নির্মাণের প্রস্তুুতি গ্রহণ সত্ত্বেও দীর্ঘ ছয় মাসেও প্রায় ১২৫কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ আরম্ভ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় সীমান্তের ১৫০গজের বাইরে জরুরি ভিত্তিতে অস্থায়ী টিনশেড ভবন নির্মাণ করে আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে আপাতত ইমিগ্রেশন কার্যক্রম চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রামগড় স্থলবন্দর চালুর লক্ষ্যে রামগড়ের মহামুনি এলাকায় অধিগ্রহণকৃত ১০একর জায়গায় বন্দরের প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর মধ্যে আইসিপি, কাস্টমস, প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ভবন, পোর্ট বিল্ডিং, ট্রান্সশিপমেন্ট শেড, ওয়্যার হাউজ, ইয়ার্ডসহ বিভিন্ন অফিস ও আবাসিক ভবন ইত্যাদি নির্মাণের জন্য ১২৫কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মনিকো লিমিটেড নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কার্যাদেশ পাওয়ার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কাজ শুরুর প্রস্তুতি হিসেবে প্রকল্প এলাকায় ওয়ার্কার শেড নির্মাণ, নির্মাণসামগ্রী ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি সাইডে নিয়ে আসে। প্রকৌশলী, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও নির্মাণ শ্রমিক সব মিলিয়ে প্রায় ৪০জন লোকবল যোগদান করে এ প্রকল্পে। প্রয়োজনীয় প্রস্তুুতি সমাপ্ত করার পর গত ১১ই জানুয়ারি কাজ শুরু করলে বিএসএফ এতে বাঁধা দেয়। সীমান্তর জিরো রেখা থেকে দেড়শ গজের মধ্যে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইনে বিধি নিষেধের কারণ দেখিয়ে বিএসএফ বাঁধা দিয়ে কাজ বন্ধ করে দেয়।
এদিকে সর্বশেষ গত ২২শে জুন নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা রামগড়ের মহামুনি এলাকায় অধিগ্রহণ করা স্থলবন্দরের জায়গা সরেজমিন পরিদর্শন করেন। পরে তারা রামগড় পৌরসভার সম্মেলন কক্ষে বৈঠক করেন। বৈঠকে দুই-তিন মাসের মধ্যে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম চালু এবং ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে সীমান্তের ১৫০গজের মধ্যে রামগড় স্থলন্দরের অধিগ্রহণকৃত জায়গায় বন্দরের স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের কাজ করতে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান। এর আগে গত ১৪ই ফেব্রুয়ারি নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বাংলদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন পদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে রামগড়ে স্থলবন্দরের প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শনে আসেন। এ সময় তিনি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের মাধ্যমে বিএসএফের বাধার বিষয়টি সুরাহা করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বললেও এখনো সীমান্ত সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হয়নি।
বাংলাদেশ রিজিয়নল কানেক্টিভিটি প্রজেক্ট-১ এর আওতাধীন রামগড় স্থলবন্দর প্রকল্পের পরিচালক(পিডি) মো: সরোয়ার আলম জানান, প্রকল্পের কাজ করার সম্মতির জন্য বিএসএফের চাহিদা অনুযায়ী গত ৯ই মে রামগড় ৪৩বিজিবির মাধ্যমে প্রকল্পের মাস্টার প্ল্যান, ডিজাইন, ড্রয়িং, লে-আউট প্রভৃতি তথ্য বিজিবির মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে।
রামগড় ৪৩ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো: হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সীমানা আইন অনুযায়ী জিরো রেখা হতে ১৫০গজের মধ্যে কোনো পক্ষই স্থায়ী কোনো অবকাঠামো বা স্থাপনা নির্মাণ বা স্থাপন করতে পারবে না। রামগড় স্থলবন্দরের অধিগ্রহণ করা জায়গাটি ১৫০গজের মধ্যে হওয়ায় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষা বাহিনী কাজে বাঁধা দেয়। তিনি বলেন, কাজের সম্মতির জন্য প্রকল্পের যাবতীয় তথ্য বিএসএফের কাছে পাঠানো হয়েছে। তারা জানিয়েছে, তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেলে তারা কাজ করতে দেবে।’
রামগড়-সাব্রুম স্থলবন্দর চালুর লক্ষ্যে ভারতের অর্থায়নে ফেনী নদীর ওপর নির্মিত বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১ ২০২১ সালের ৯ই মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উদ্বোধন করেন। ২০১০সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিলিসফর কালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সঙ্গে বৈঠকে রামগড়-সাব্রুম স্থলবন্দর চালুর যৌথ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
অনুন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অতি দূরত্বের কারণে সেভেন সিস্টার নামে পরিচিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যেই সে দেশের সরকার রামগড়-সাব্রুম স্থলবন্দর ও ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। রামগড় থেকে ৭০কিলোমিটার দূরের চট্টগ্রাম বন্দরকে টার্গেট করেই তাদের এ পরিকল্পনা।
রামগড় স্থলবন্দর চালু হলে বাংলাদেশ থেকে নানান প্রসাধন সামগ্রী, সিরামিক ও মেলামাইল পণ্য, সিমেন্ট, ইট, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, তামাক জাতীয় পণ্য, শুঁটকি প্রভৃতি ত্রিপুরা রাজ্যে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। অন্য দিকে ত্রিপুরা থেকে কাঠ, বাঁশ, পাথর, মসলা প্রভৃতি পণ্য আমদানি করা যাবে। প্রসার ঘটবে পর্যটনশিল্পের।
সীমান্তর ওপারের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, মৈত্রী সেতু নির্মাণের সমানতালে সেখানকার অভ্যন্তরীণ মহাসড়কের উন্নয়নসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। গত ৩রা অক্টোবর সাব্রুম থেকে আগরতলা রেল সার্ভিস চালু করা হয়েছে। সাব্রুমে স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তুলতে বিপুল পরিমাণ জমিও অধিগ্রহণ করেছে। অন্যদিকে রামগড়-সাব্রুম স্থলবন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের সংযোগ সড়ক হিসেবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বারৈয়ারহাট হতে রামগড় পর্যন্ত সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। বর্তমানে এ সড়কে প্রায় ২৭০কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬টি ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণের কাজ করছে জাইকা। চট্টগ্রামের নাজিরহাট হতে রামগড় স্থলবন্দর পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপনের পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন