দেশে প্রতিবছর অকেজো হচ্ছে ৪০ হাজারের বেশি কিডনি
বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ কোন না কোনোভাবে কিডনি রোগে ভুগছে। আর আক্রান্তদের মধ্যে ৪০ হাজারের কিডনি পুরোপুরি অকেজো হচ্ছে প্রতিবছর। কিডনি ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপ থেকে পাওয়া পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে এ বিষয়ে দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা। প্রতিবেদনটি পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো-
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ধরনের রোগীর জন্য মাত্র দুই রকম চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। হয় ডায়ালাইসিস অর্থাৎ যন্ত্রের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে কিডনির কাজ করানো বা কিডনি প্রতিস্থাপন। কিন্তু এই দুই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিই ব্যয়বহুল।
ঢাকার শাহবাগ এলাকায় বিশেষায়িত ডায়াবেটিক হাসপাতাল বারডেমে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও কিডনি রোগীর অনেক ভিড়।
ডায়াবেটিস থাকলে সেটিও একটা পর্যায়ে গিয়ে কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ হয়ে উঠতে পারে। ফলে ডায়াবেটিক হাসপাতালে কিডনি রোগের চিকিৎসার জন্য বড় ইউনিট রয়েছে।
বারডেমে একটি ওয়ার্ডে অসুস্থ এক তরুণীর পাশে থাকা তার অভিভাবক ফাতেমা আমিনের সাথে কথা হয়।
তিনি জানান, পাঁচ বছর বয়সে এই তরুণীর ডায়াবেটিস ধরা পড়েছিল। এখন ১০ বছর পর তার কিডনি বিকল হয়ে গেছে।
তারা শেষ অবস্থায় চাঁদপুর জেলা শহর থেকে ঢাকায় বারডেমে এসেছেন।
ফাতেমা আমিন বলছিলেন, তরুণীটির বাবা-মা অনেক আগে মারা গেছেন। এখন বোনের মেয়ের চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে তিনি চরম সংকটে পড়েছেন।
‘এখন ডায়ালাইসিস করাতে মাসে ৪০ হাজার টাকা প্রয়োজন। এই টাকা যোগাড় করা আমাদের মতো নিম্ন পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। আমার স্বামীও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। এখন কি করবো জানি না।’
ডায়ালাইসিস খরচ
ডায়ালাইসিসের ব্যয় সরকারিভাবে নির্ধারিত হয় না। সরকারি হাসপাতালগুলোতে একবার ডায়ালাইসিস করাতে আড়াই হাজার টাকা থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ে।
আর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এই ব্যয় অনেক বেশি। হাসপাতালগুলো নিজেদের মতো করে তা নির্ধারণ করে থাকে। এসব হাসপাতালে একবার ডায়ালাইসিস করাতে সাড়ে তিন হাজার টাকা থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়।
কিডনি অকেজো হওয়া একজন রোগীকে সপ্তাহে দুই বা তিনবার পর্যন্ত ডায়ালাইসিস করাতে হয়।
বারডেম হাসপাতালের কিডনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সারোয়ার ইকবাল চিকিৎসা দেয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, রোগীদের পরিবারগুলোকে এই ব্যয় বহন করতে হিমশিম খেতে হয়।
তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যায়ে কিডনি বিকল হওয়ার কারণে যত রোগীর ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হয়, তার ৯০ ভাগ রোগীই এক বা দুইবার ডায়ালাইসিস করার পর আর এটা করাতে পারে না। কারণ এর ব্যয় সামলাতে পারে না। ১০ ভাগের কম লোক এটার ব্যয় ভার বহন করতে পারে। এ ছাড়া কিডনি প্রতিস্থাপন করার ব্যয় কিছুটা কম হলেও এর ডোনার পাওয়া যায় না।’
ঢাকার কামরাঙ্গীর চর এলাকার আসমা বেগম বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন দীর্ঘ সময় ধরে। এখন অকেজো কিডনির চিকিৎসায় ডায়ালাইসিস শুরু করার অর্থের যোগান নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
চিকিৎসা সুবিধা
কিডনি ফাউন্ডেশনের প্রধান অধ্যাপক হারুন আর রশিদ বলছিলেন, ব্যয়ের বিষয়টা যেমন আছে, তেমনি কিডনি রোগের শেষ অবস্থার রোগীদের জন্য দেশে ডায়ালিসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের সুবিধাও এখনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি।
‘বছরে ৪০ হাজার রোগীর যে কিডনি বিকল হচ্ছে। তাদের সবার চিকিৎসা দিতে চাইলে মানসম্মত হানপাতালের পাশাপাশি চিকিৎসার ব্যাপ্তিটা দরকার। এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে নতুন ৪০ হাজার রোগীকে ডায়ালাইসিস সেবা দেয়া এবং প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয় না।’
‘আমাদের যে সুযোগ সুবিধা আছে, তাতে আমরা ৪০ হাজার রোগীর মাত্র ২০ভাগকে ডায়ালাইসিস বা প্রতিস্থাপন করে দিতে পারি। তাতে ৮০ ভাগ রোগীই চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেন।’
নারীদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরও প্রকট।
পরিবারের সহযোগিতার অভাবে নারীদের একটা বড় অংশ চিকিৎসক পর্যন্তই যেতে পারেন না। অনেক নারী রোগীর সমস্যা দেখে এমন ধারণা হয়েছে বারডেম হাসপাতালের ড. মেহরুবা আলমের।
‘ডাক্তারের কাছে মেয়েদের অ্যাকসেস এখনও পুরুষের তুলনায় কম। মেয়েরা চিকিৎসকের কতটা সাহায্য পেলো, তার অর্থ কতটা আছে বা পরিবার তার চিকিৎসার জন্য কতটা অর্থ বরাদ্দ রাখছে, এসব বিষয় মেয়েদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’
‘মেয়েদের কিডনির সমস্যা একটা পর্যায়ে তাদের সন্তান ধারণের ক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যদি সন্তান এসেও যায়, তাতে অনেক জটিলতা থাকে।
‘আমাদের গত বছর একজন রোগী বাচ্চা ধারণ করলেন, ঝুঁকি থাকলেও হয়তো বাচ্চাটাকে বাঁচানো যেতো। মেয়েটা বাচ্চা রাখতে চাইলেও তার স্বামী কোনভাবেই রাজি হন না। ফলে আমাদের বাচ্চাটাকে গর্ভপাত করাতে হয়েছে।’
কেন কিডনি বিকল হয়ে শেষ পর্যায়ে রোগীরা চিকিৎসকের কাছে যান?
চিকিৎসকরা বলছেন, কিডনি রোগের উপসর্গ প্রথমে বোঝা যায় না। কিডনির অনেকটা ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত কোনো উপসর্গ দেখা দেয় না।
তবে এই রোগের অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে, নেফ্রাইটিস বা প্রস্রাবের প্রদাহ, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ বা অতিমাত্রায় ব্যথানাশক ওষুধ প্রয়োগ করা এবং খাদ্যাভাস। বংশগত বিষয়ও এই রোগের একটা কারণ হতে পারে।
চিকিৎসকরা বলেছেন, যে সব রোগের কারণে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেসব রোগে আক্রান্তরা নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করান না। আর মানুষ এখনও সেভাবে সচেতন হয়ে উঠেনি বলে তারা মনে করেন।
অধ্যাপক সারোয়ার ইকবাল বলেছেন, একেবারে শেষ পর্যায়ে কিডনি অকেজো হওয়ার পর বেশিরভাগ রোগী চিকিৎসকের কাছে যান।
‘কী কারণে কিডনি রোগ বেশি হয়, সেটা মানুষের জানা উচিত। ডায়াবেটিসসহ যে সব কারণে বেশি হয়, সেগুলো কিন্তু প্রতিরোধ করা সম্ভব।’
কিডনি প্রতিস্থাপনের কতটা সুযোগ আছে
প্রতিবার ডায়ালাইসিস করার জন্য বড় অংকের অর্থ গুনতে হয়। এর সাথে তুলনা করলে কিডনি প্রতিস্থাপন বা সংযোজন করার ক্ষেত্রে খরচ কিছুটা কম বলে চিকিৎসকরা বলছেন।
তাদের দেয়া হিসাব অনুযায়ী, এখন দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। তবে সমস্যা হচ্ছে কিডনি পাওয়াটা বেশ কঠিন।
কিডনি প্রতিস্থাপন আইন কিছুটা শিথিল করে একজন রোগীর বাবা-মা ভাই-বোনের পাশাপাশি চাচাতো ভাইবোনের কিডনি দেয়ার ব্যবস্থা আনা হয়েছে। একই সাথে হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় থাকা ব্যক্তির কিডনি নেয়ার বিধানও করা হয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা কিডনি প্রতিস্থাপন ফাউন্ডেশনের প্রধান অধ্যাপক মো. আব্দুস সালাম বলছিলেন, আইনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হলেও বাংলাদেশে এখনও মৃত্যুশয্যায় থাকা ব্যক্তির কিডনি পাওয়ার মতো পরিবেশ হয়নি।
‘মৃত ব্যক্তির কিডনি নেয়ার কথা আইনে থাকলেও আমরা এখনও এটা করতে পারিনি। মনে হয়, আমাদের দেশের মানুষ এখনও এটার জন্য প্রস্তুত নন।’
‘আইসিইউ’তে যেসব রোগী থাকে, একটা পর্যায়ে তাদের ব্রেন ডেড হয়ে যায়। তখন তার আর বেঁচে থাকার কোনো সম্ভবনাই থাকে না। এমন কন্ডিশনে আমরা কিডনি নিতে পারি। কয়েক মাস আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা সেন্টারে বিদেশি টিমসহ আমরা চেষ্টা করেছিলাম যে, কোনো একটা ব্রেন ডেড রোগীর আত্মীয়-স্বজন যদি রাজি হয় কিডনি দিতে। কিন্তু কেউই রাজি হননি। ভবিষ্যতে এটা হলে হয়তো কিডনি পাওয়ার সমস্যা কিছুটা কমতে পারে।’
নারীর জন্য কিডনি পাওয়া আরও কঠিন
চিকিৎসকরা বিশেষভাবে উল্লেখ করছেন যে, পুরুষ রোগীর চাইতে নারী রোগীর জন্য কিডনি পাওয়া অনেক সময় বেশি কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
বারডেম হাসপাতালের ডা. মেহরুবা আলম বলছিলেন, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে পুরুষ রোগীর জন্য কিডনি নেয়ার প্রয়োজন যখন হয়, তখন তার স্ত্রী প্রথমে কিডনি দেয়ার জন্য এগিয়ে আসেন। কিন্তু নারী রোগীর ক্ষেত্রে স্বামীর সহযোগিতা সেভাবে থাকে না।
ডা. মেহরুবা আলম তাদের হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন কর্মকাণ্ডে এমন চিত্রই পেয়েছেন।
‘আমাদের হাসপাতালে যতজনের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, তাতে একজন স্বামী তার স্ত্রীর জন্য কিডনি দিয়েছেন, এমন কোনো রেকর্ড নেই। কিন্তু স্ত্রী স্বামীর জন্য কিডনি দিয়েছেন, এ রকম ১০/১২টা ঘটনা আছে। প্রথমে তো কাছের মানুষের কাছ থেকেই কিডনি দেয়ার বিষয় আসে। সেখানেই মেয়েরা স্বামীর সহযোগিতা পায় না।’
কী করা উচিত
কিডনি রোগের চিকিৎসার ব্যয় এবং সুযোগ-সুবিধা কোনোটাই পর্যাপ্ত নয়। ঢাকায় সরকারি হাসপাতাল ছাড়াও ব্যক্তি মালিকানায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কিছু ডায়ালাইসিস সেন্টার গড়ে উঠেছে।
ঢাকার বাইরে বড় কয়েকটি শহরে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে সীমিত পর্যায়ে এই চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বেশিরভাগ জেলায় কিডনি রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা সেভাবে নেই।
অধ্যাপক হারুন আর রশিদ বলছিলেন, কিডনির চিকিৎসা বিস্তারে কমিউনিটি হাসপাতালগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
‘লাভজনক সেন্টারগুলোতো এটা চিন্তাও করে না যে, একজন রোগীকে কত কম খরচে চিকিৎসা দেয়া যাবে। অলাভজনক যেসব সেন্টার আছে, সেগুলো খুবই অপ্রতুল। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা- এমন সাত আটটা শহরে কিছু কিছু ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা আছে এবং সেটা একেবারে নগণ্য। গ্রাম পর্যায়ে এখন এটা চিন্তা করা খুব দুস্কর।’
‘কোনোমতেই বাংলাদেশে আগামী ২০ বছরে সব কিডনি রোগীকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে না। তবে একটা অবকাঠামো আছে, সেটা হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক। এই কমিউনিটি ক্লিনিকে যদি উদ্যোগ নেয়া যায়, তাহলে আমরা কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস এবং উচ্চরক্তচাপ-এসব রোগ প্রতিরোধ করতে পারি।’
যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, সারাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে কিডনির চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসার ইউনিট করা এবং চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে আনার ব্যাপারে বিভিন্ন পরিকল্পনা বিবেচনা করা হচ্ছে।
কিন্তু চিকিৎসকরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অপ্রতুলতার কথাও তুলে ধরছেন। বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টানোর বিষয়ে চিকিৎসকদের সন্দেহ রয়েছে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন