মার্কিন সাবেক রাষ্ট্রদূত বিউটেনিসের সাক্ষাৎকারে চাঞ্চল্যকর তথ্য
বাংলাদেশের জনগণের প্রশংসা করি রাজনীতিবিদদের করতে পারি না
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস বলেছেন, বাংলাদেশে কাটানো সময়টা ছিল দারুণ। আমি বাংলাদেশের জনগণের খুব প্রশংসা করি। কিন্তু রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে সেটা করতে পারি না।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের প্রশংসা না করার কারণ বিভিন্ন ঘটনার প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা করেছেন বিউটেনিস।
তার মতে, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের কর্মকান্ড ছিল তার জন্য বিব্রতকর। সবাই তাকে রাজনীতিতেও জড়িয়ে ফেলতে চাইত বলেও মনে করেন তিনি। প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস ২০০৬ সালের ১৩ এপ্রিল থেকে ২০০৭ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। মাত্র ১৪ মাস দায়িত্ব পালন করলেও সেই সময়টা ছিল বাংলাদেশের জন্য ঘটনাবহুল।
কারণ তিনি বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিকের সময় থেকে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুরুর কয়েক মাস ছিলেন ঢাকা। ২০১৪ সালে অবসরের পর বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে কর্মজীবনে প্রত্যক্ষ করা নানা ঘটনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসোসিয়েশন ফর ডিপ্লোম্যাটিক স্টাডিজ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের ফরেন অ্যাফেয়ার্স ওরাল হিস্টরি প্রোগ্রামকে সাক্ষাৎকার দেন প্যাট্রেসিয়া বিউটেনিস। চার্লস স্টুয়ার্ট কেনেডিকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। বিউটেনিস বলেন, ঢাকায় যাওয়ার পরপরই মনে হয়েছে যে এখানে সবাই তাঁকে রাজনীতিতে জড়ানোর চেষ্টা করছেন।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে নেতারা অব্যাহতভাবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন এবং তাঁদের অবস্থানের বিষয়ে কোনো না কোনো সমর্থন-সহযোগিতা চাইতেন। এমনটি সব দেশে হয় না। এ নিয়ে সব সময় তাঁকে সতর্ক থাকতে হতো। এটি কিছুটা বিব্রতকর। অনেক সময় আমাকেও শুনতে হতো ‘দয়া করে প্রধানমন্ত্রীকে এটি বলুন’ বা ‘দয়া করে বিরোধী দলকে এটি বলুন’।
সাক্ষাৎকারে বিউটেনিস বলেন, বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগের খবর পেয়ে আমি আগের রাষ্ট্রদূত হ্যারি টমাসের সঙ্গে দেখা করি। হ্যারি মনে করে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মানে রাজা। বাংলাদেশে আমার ১৪ মাসের শেষের দিকে একটি পত্রিকা ‘বাংলাদেশের চার রানী’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই চার রানী হলেন- প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা, ভারতীয় হাইকমিশনার বীণা সিক্রি এবং আমি। যেন বাংলাদেশে যা কিছু ঘটে সে সবকিছুই আমরা ঘটাই। আমরা তখন বাংলাদেশকে এমন একটি দেশ হিসেবে ভাবতাম যা সামাজিক ক্ষেত্রে বিশেষত নারী স্বাস্থ্য, শিশুমৃত্যু ইত্যাদিতে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছিল। তবে ইস্যু ছিল একটাই, প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তারা একজনের পর আরেকজন প্রধানমন্ত্রী হন। তারা লড়াইরত বেগম হিসেবে পরিচিত। আমার সময়ে নির্বাচনী প্রচারণা এবং ভোটদানের সময় বাড়তে থাকা সহিংসতা ছিল ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়।
বিউটেনিস বলেন, পাকিস্তান ও ভারত দুই দেশেরই গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বাংলাদেশে সক্রিয় থাকার বিষয়টি ছিল স্পষ্ট। বিএনপি ঐতিহ্যগতভাবে পাকিস্তানের কাছের, আওয়ামী লীগ ভারতের। পাকিস্তানের ‘আইএসআই’ বিএনপিতে বিপুল অর্থ ঢালছিল এমন বিশ্বাসযোগ্য গুঞ্জন ছিল। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ কী করছিল তা জানি না।
সাক্ষাৎকারে বিউটেনিস বলেন, তিনি যখন রাষ্ট্রদূত হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন ইসলামের নামে উগ্রবাদের লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। উগ্রবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত কারও হুমকির কারণে বাংলাদেশ থেকে ‘পিস কোর’ প্রত্যাহার করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কিছু ‘বিরক্তিকর’ ঘটনা ঘটার কথা উল্লেখ করেন বিউটেনিস। তিনি বলেন, উভয় দলের রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করা হচ্ছিল। বিউটেনিস বলেন, গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা যাতে মুক্তি পান সে জন্য তাঁকে হস্তক্ষেপ করতে বলছিলেন। তাঁর মতে, ব্যক্তিবিশেষের ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে আমি অনীহা দেখিয়েছি। ওই আলোচনা করা যথার্থ হতো না। কারণ ওই ব্যক্তিবিশেষ দুর্নীতিবাজ বা দুর্নীতিবাজ নন, সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা বা তথ্য ছিল না।
এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেফতার ব্যক্তিদের মুক্ত করার বিষয়ে কয়েকটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রেসিয়া বিউটেনিস। তিনি বলেন, সেসময় দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতারের অন্যতম টার্গেট ছিলেন খালেদা জিয়ার ছেলে ও তাঁর উত্তরাধিকারী তারেক রহমান। তিনি (তারেক রহমান) তাঁর মা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বেশ ক্ষমতাবান ছিলেন এবং লোকজন তাঁকে ভয় পেত। একদিন আমি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ পেলাম। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পাঁচতারা একটি হোটেলে গেলাম। খালেদা জিয়া একটি কক্ষে তাঁর পুত্রবধূর সঙ্গে বসে ছিলেন। তারেকের স্ত্রীর সঙ্গে আমার আগেও দেখা হয়েছিল।
বিউটেনিস বলেন, ‘খালেদা জিয়া চেয়েছিলেন আমি যেন তাঁর ছেলেকে কারাগার থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করি। বিষয়টি এমন যেন আমার সেই ধরনের প্রভাব আছে। আমি চেষ্টা করিনি। আমার সেই প্রভাব থাকলেও আমি চেষ্টা করতাম না। আবারও বলব, আমাদের অবস্থান ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং তাদের সামরিক সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানানো, যেন বন্দীদের মানবাধিকার ও আইনি প্রক্রিয়াকে সম্মান করে।
আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করে বিউটেনিস বলেন, বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম গ্রেফতার হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী বিউটেনিসের সঙ্গে দেখা করে স্বামীর মুক্তির জন্য হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন। তবে ওই ব্যক্তির নাম তিনি উল্লেখ করেননি। বলেছেন, ওই ব্যক্তির স্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের বাসায় অনেকবার এসেছিলেন। অন্য রাষ্ট্রদূতদের কাছেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন।
বিউটেনিস বলেন, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ায় বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর জানতেন যে তিনি ‘টার্গেট’ হবেন। তিনি আমাকে ও ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য ডাকলেন। আমরা তাতে সাড়া দিই। তিনি আমাদের কাছে আমাদের দেশের ভিসা চান। বাবর বলেছিলেন, তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা আছে এবং চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে যাওয়া প্রয়োজন। তবে আমরা জানতাম, নিরাপদে থাকার জন্য তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছেন। এরপর তিনি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেছেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন