ভিজিএফের গম নিয়ে হরিলুট
![](https://ournewsbd.net/wp-content/uploads/2017/06/rangpur-bureau-photo-1_50699_1498764395.jpg)
![](https://ournewsbd.net/wp-content/uploads/2025/02/475351977_1256003665483861_2959209934144112011_n.jpg)
রংপুরের পীরগঞ্জে ভিজিএফের গম নিয়ে চলছে হরিলুট। ঈদে দুস্থদের মাঝে চালের পরিবর্তে ১৩ কেজি করে গম দেয়ার কথা থাকলেও স্থানীয় চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা সিন্ডিকেট করে বেশিরভাগই গমই বিক্রি করে দিয়েছে। কিছু গম বিতরণ করা হলেও তা ছিল নিন্ম মানের পোকায় খাওয়া। অভিযোগের ভিত্তিতে পীরগঞ্জের রায়পুর থেকে মঙ্গলবার ও পাঁচগাছী ইউনিয়ন থেকে বুধবার শতাধিক বস্তা গম উদ্ধার করেছে উপজেলা প্রশাসন।
বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, বৃহস্পতিবারের অভিযানে পীরগঞ্জের কুমেদপুর ইউনিয়নের রসুলপুর বাজার থেকে দুই শতাধিক বস্তা গম জব্দ করা হয়েছে। তবে এ সম্পর্কে প্রশাসনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভিজিএফের গম নিয়ে নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে।
রংপুরের বদরগঞ্জে বৃহস্পতিবার ভিজিএফের ১৪৭ বস্তা গম এক ব্যবসায়ীর গুদাম থেকে জব্দ করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় আরও দুটি গুদামে অভিযান চালাতে গেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বাধায় তা বন্ধ করে দেয়া হয়। দেড় হাজার বস্তা ভিজিএফ গম কালোবাজারে বিক্রির খবর পেয়ে এ অভিযানে নামেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ঈদের আগে ভিজিএফ ত্রাণ বিতরণ না করায় স্বরূপকাঠির ৬ হাজার ৫৭৫ পরিবারের নিরানন্দে ঈদ কাটে। পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার প্রায় ত্রিশ হাজার অতিদরিদ্র পরিবার ঈদের ভিজিএফের গম থেকে বঞ্চিত হয়।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার দুস্থদের মাঝে ১৩ কেজি করে ভিজিএফের গম আংশিক বিতরণ করা হলেও তা ছিল পোকায় খাওয়া নিন্ম মানের।
রংপুর : এদিকে রংপুরের বদরগঞ্জে অভিযান চালিয়ে বৃহস্পতিবার ভিজিএফের ১৪৭ বস্তা গম এক ব্যবসায়ীর গুদাম থেকে জব্দ করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। গোপন খবরের সূত্র ধরে সেখানে অভিযান চালানো হয়।
এ সময় আরও দুটি গুদামে অভিযান চালাতে গেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতিরোধের মুখে অভিযান স্থগিত করতে বাধ্য হন ভ্রাম্যমাণ আদালত। বদরগঞ্জে দুস্থদের জন্য বরাদ্দ দেড় হাজার বস্তা ভিজিএফের গম কালোবাজারে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগের পর ভ্রাম্যমাণ আদালত ওই অভিযান চালান।
বদরগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত ব্যবসায়ী নিখিল কুণ্ডুর গুদামে অভিযান চালিয়ে এ গম জব্দ করেন।
এর আগে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের কথা জানতে পেরে নিখিল কুণ্ডু তার গুদামে মজুদ ৪শ’ বস্তা সরকারি গম মেঝেতে ছড়িয়ে গুদামে তালা লাগিয়ে পালিয়ে যান। ফলে আদালত ওই গম জব্দ করতে পারেননি।
খবর পেয়ে আওয়ামী লীগ উপজেলা কমিটির সভাপতি ও পৌরসভার মেয়র উত্তম কুমার সাহা এবং আওয়ামী লীগ নেতা উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলে রাব্বি সুইট ঘটনাস্থলে আসেন। তারা দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন।
পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত অপর ব্যবসায়ী মানিক রাহার ও নিতাই কুণ্ডুুর গুদামে অভিযান চালাতে গেলে আওয়ামী লীগের ওই দুই নেতা সেখানে বাধা দেন। শেষ পর্যন্ত তাদের প্রতিরোধের মুখে ভ্রাম্যমাণ আদালত কার্যক্রম স্থগিত করতে বাধ্য হন।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়াসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা।
ঘটনার সময় স্থানীয় সাংবাদিকরা ছবি ধারণ করতে গেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেই উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়র সাংবাদিকদের হুমকি-ধমকি দেন।
অভিযানের সময় গুদামের ভেতরে দেখা যায়, ‘খাদ্য অধিদফতরের সিল মারা ৫০ কেজির অন্তত পাঁচ শতাধিক বস্তা গম সেখানে মজুদ করে রাখা হয়েছে। এর পাশে অপর দুটি গুদামেও গম রয়েছে বলে নিশ্চিত হন ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতিরোধের কারণে অদালত সেখানে অভিযান চালাতে পারেননি।
জানতে চাইলে মুঠোফোনে ব্যবসায়ী নিখিল কুণ্ডু বলেন, ‘কারও কাছ থেকে ফ্রি গম নেইনি। নগদ টাকা দিয়ে গম কিনেছি। এতে আমার অপরাধ কি? সরকারি গম সবাই তো কেনেন। আমি কিনলে দোষ কোথায়?’
কালুপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল হক মানিক বলেন, কিছু বেপারি পরিষদের বাইরে থেকে গম ক্রয় করেছেন। তবে আমার ইউনিয়নে ভিজিএফের গম বিতরণে কোনো অনিয়ম হয়নি। আর আমি কোনো ব্যবসায়ীর কাছে গম বিক্রি করিনি।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিধি মোতাবেক আদালত গঠন করে ১৪৭ বস্তা গম জব্দ করা হয়। অপর দুটি গুদামে গম মজুদ থাকার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ওই গুদামের চাবি না থাকায় তা জব্দ করা সম্ভব হয়নি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাশেদুল হক বলেন, গম কেনার সঙ্গে যেসব অসাধু ব্যবসায়ী জড়িত আছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সঙ্গে অন্যান্য গুদামে মজুদ থাকা গম উদ্ধারে চেষ্টা চলছে।
রংপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘ভিজিএফের গম ব্যবসায়ীর ঘরে থাকা দণ্ডনীয় অপরাধ। আর কোথায় কোথায় কার কাছে কি পরিমাণ গম আছে তা জব্দ করার জন্য ইউএনওকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
পীরগঞ্জ (রংপুর) : পীরগঞ্জ পৌরসভার ১ হাজার ৫৪০ এবং ১৫টি ইউনিয়নে ৬৭ হাজার ৭৫০ পরিবারের মাঝে ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ঈদপূর্ব ভিজিএফের গম বিতরণের নির্দেশ দেয়া হয়। প্রতি পরিবারকে ১০ কেজি করে মোট ৬৯২ মে. টন চাল বরাদ্দ দেয়া হলেও খাদ্য বিভাগ চালের পরিবর্তে ১৩ কেজি করে গম বরাদ্দ দেয়।
কিন্তু ভিজিএফের গম সিন্ডিকেট করে বিক্রি করে দেয়ায় অভিযোগের পর উপজেলা প্রশাসন ঈদের পর গম উদ্ধারে অভিযানে নামে। মঙ্গলবার উপজেলার রায়পুর ইউনিয়ন থেকে মজুদ ৫০ কেজি ওজনের ৫৬ বস্তা এবং পাঁচগাছী ইউনিয়নের কদমতলীর বাজার থেকে ৫৩ বস্তা গম জব্দ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবারও উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়। পরে কুমেদপুর ইউপির রসুলপুর বাজার থেকে দুই শতাধিক বস্তা গম উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে প্রশাসন থেকে তা নিশ্চিত করা হয়নি।
সূত্র বলছে, গম নিম্নমানের হওয়ায় অনেক ভিজিএফ কার্ডধারী ত্রাণ তুলে তা বিক্রি করে দিয়েছে। সেগুলোই ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা ক্রয় করে গুদামজাত করেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিভিন্ন বাসাবাড়িতে রাখা সেসব গমই জব্দ করেছে।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার পীরগঞ্জ উপজেলার ইউএনও কমল কুমার ঘোষ বলেন, গমগুলো অভিযোগের ভিত্তিতে আটক করা হচ্ছে। এগুলো লুটপাট করা হয়েছে কিনা, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তারপর মামলা করে তদন্ত সাপেক্ষে আসামি করা হবে।
পীরগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) হারুন অর রশিদ বলেন, ইউএনও স্যারের সঙ্গে থেকে গম উদ্ধার করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত রায়পুর ও পাঁচগাছী ইউনিয়ন থেকে গম উদ্ধার করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবারও রসুলপুর বাজার থেকে বেশকিছু বস্তা গম উদ্ধার করা হয়েছে। এদিকে উপজেলার চৈত্রকোল ইউপিতে ঈদের আগের দিন কিছু গম বিতরণের পর চেয়ারম্যান এবং সচিব কার্ডধারীদের রেখেই চলে যায়। ফলে অনেক কার্ডধারী গম পায়নি।
উপজেলার টুকুরিয়া ইউনিয়নে ঈদের আগে কোনো গম বিতরণ করা হয়নি বলে ইউনিয়নটির চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মণ্ডল জানান। অধিকাংশ চেয়ারম্যান ও মেম্বারই সিন্ডিকেট করে নিজেদের নামে শত শত কার্ড করে চাল-গম বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
দশমিনা : ঈদের আগে অতিদরিদ্রদের জন্য বিশেষ ভিজিএফের গম বিতরণের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার প্রায় ত্রিশ হাজার অতিদরিদ্র ঈদের ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হয়।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কোনো ত্রাণ বিতরণ করা হয়নি। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অফিস বলছে, উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মোট ৩০ হাজার ৩৫০ জন অতিদরিদ্রের মাঝে বিতরণের জন্য ৪০২ পয়েন্টে ৮৫০ টন গম বরাদ্দ দেয়া হয়।
স্বরূপকাঠি (পিরোজপুর) : ভিজিএফের ত্রাণ না পেয়ে স্বরূপকাঠির ৬৫৭৫টি দুস্থ পরিবারের নিরানন্দ ঈদ কেটেছে। গোডাউনে গমের পর্যাপ্ত মজুদ না থাকায় স্বরূপকাঠির চারটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার ৬ হাজার ৫৭৫ জন দুস্থ পরিবারকে ঈদুল ফিতরের ভিজিএফ ত্রাণ বিতরণ করতে পারেননি জনপ্রতিনিধিরা।
উলিপুর (কুড়িগ্রাম) : ঈদে উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার প্রায় ৮০ হাজার দুস্থ পরিবারের মাঝে ভিজিএফের ১৩ কেজি করে পোকায় খাওয়া নিন্ম মানের গম আংশিক বিতরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার দুস্থ পরিবার মানুষজন ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
ইউপি চেয়ারম্যানরা অভিযোগ করেছেন, ভিজিএফের চালের পরিবর্তে খাওয়ার অনুপযোগী পোকায় খাওয়া গম গোডাউন থেকে উত্তোলন করতে আমাদের বাধ্য করা হচ্ছে। এসব গম আংশিকভাবে বিতরণ করা হয়েছে।
বেগমগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন জানান, পোকায় খাওয়ার গম সম্পর্কে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে জানিয়েছি। জানতে চাইলে উপজেলা খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, গম গত বছরের হওয়ায় কিছুটা পোকায় খাওয়া হলেও জীবন্ত পোকা নয়। এ গম খেলে কোনো ক্ষতি হবে না বলে তিনি আশ্বস্ত করেন।
![](https://ournewsbd.net/wp-content/uploads/2024/12/469719549_122234398946008134_2936380767280646127_n.jpg)
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন