মাদকবিরোধী অভিযান ও শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন
গতকাল আমার মেয়ে কুঁড়ি লন্ডন থেকে ফিরেছে। ওকে আনতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ বিমানের BG202 কখনো ঠিক সময়ে ঢাকা আসে না। কখনো দু-এক বার সিলেটে এলেও সেখান থেকে ডিলে শুরু হয়। গতকাল সিলেট বিমানবন্দরে উড়োজাহাজটি প্রায় দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিল। প্রথম বলা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর মুভমেন্ট আছে। তাই ওড়ার অনুমতি পাচ্ছে না। হেলিকপ্টারে চড়তে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুভমেন্টের কারণে মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আকাশে থাকলে অন্য হেলিকপ্টার চালাতে দেওয়া হয় না। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিমানের জন্য যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চলাচলে বাধা তা জানা ছিল না। পরে জানলাম প্রধানমন্ত্রীর জন্য নয়, থাইল্যান্ডের রাজকুমারী এসেছেন। তাকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। ভিআইপিতে যদিও গরম ছিল না। কিন্তু রাস্তাঘাটে প্রচণ্ড গরম। যত দেরিই হোক মেয়েটা ভালোভাবে এসেছে সেজন্য পরম করুণাময় আল্লাহর প্রতি শত কোটি শুকরিয়া।
দেশে মাদকবিরোধী অভিযান চলছে। এর মধ্যেই শতাধিক মানুষ মরে গেছে। তাদের কে অপরাধী, কে অপরাধী নয়— বিচারের সুযোগ আমাদের হাতে আর নেই। মাদকে দেশ ছেয়ে গেছে। মাদকের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হতে যত ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন জাতি তা করতে প্রস্তুত। কিন্তু তাই বলে নির্বিচারে মানুষ হত্যা কেউ মেনে নেবে না। অভিযান চালিয়ে যাকেতাকে হত্যার কারণে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠছে। সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে কিন্তু প্রমাণ নেই।’ তাহলে যাদের এ কদিন হত্যা করা হয়েছে তাদেরও তো অভিযোগের ভিত্তিতে করা হয়েছে। প্রমাণ থাকলে আইন-আদালত হতো, গুলি করে হত্যা করা হতো না। জাতীয় অনেক পত্রিকায় বদির গোষ্ঠীর কে কোথায় কতটি মাদক ব্যবসার ঘাঁটি পরিচালনা করেন তার বিবরণ দেখলাম। বদির সব আত্মীয়ই যে মাদক ব্যবসায়ী বা মাদকসেবী নন সে তো এখন শুনছি মো. একরামুল হকের হত্যার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ, পত্রপত্রিকা সব জায়গায় আলোচিত হচ্ছে একরাম একজন হতদরিদ্র ভালো লোক ছিলেন। তিনি প্রায় সময়ই বদির নাহক কাজের প্রতিবাদ করতেন। আওয়ামী লীগ-বিএনপি কখনো এক কথা বলে না। কিন্তু একরামের ব্যাপারে সবাই তাকে ভালো বলছে। এখন তাকে হত্যার কী হবে, কার কাছে তার পরিবার বিচার পাবে? পৃথিবীতে কখনো কোনো সরকার হত্যা করে পার পায়নি। বেনজীর বলেছেন, ‘যুদ্ধ চলছে, যুদ্ধ চলবে।’ বলা খুবই সোজা। নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে মারার নাম যুদ্ধ নয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বেনজীর কতটুকু ছিলেন জানি না। হানাদারদের মেশিনগানের গুলির আওয়াজে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। তাদের গায়ে গুলি লাগার প্রয়োজন পড়েনি। পত্রপত্রিকায় দেখছি মাদকের রাঘব-বোয়ালরা ইতিমধ্যেই গা ঢাকা দিয়েছে। কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এসব সত্য হলে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুতেই ব্যর্থ হয়েছে। মাদকের সঙ্গে ছোট থেকে বড় অনেকেই জড়িত। তাই চুনোপুঁটি ধরে ধরে হত্যা করে ক্ষমতাবানদের বেঁচে যাওয়ার কোনো নীলনকশা নয় তো? প্রশ্ন আরও অনেক। মাদকের পয়সা সর্বত্র বিস্তৃত। সেসব জানাজানির হাত থেকে বেঁচে যেতে নিচের সব কেটে ফেলার এ কোনো প্রয়াস কিনা? অথবা আসল লোকদের নাম জানাজানি হয়ে যেতে পারে এজন্য দুশমনদের কচুকাটা করা? এমনি কত যে প্রশ্ন মানুষের মনে। সরকার বলছে, তাদের কাছে থাকা তালিকা ধরে ধরে অভিযান করা হচ্ছে। তাহলে কি তালিকায় যারা আছে তাদের হত্যা করা হবে, আর সে হত্যার বিচার হবে না! এ সরকারের আমলে এসব হত্যার বিচার নাও হতে পারে আবার হতেও পারে। কিন্তু এ কথা সত্য, এ সরকারই শেষ সরকার নয়, আজ অথবা কাল নতুন সরকার আসবে। তারা এর চাইতেও খারাপ আবার ভালোও তো হতে পারে। তাই সবার সাবধান হয়ে চলা উচিত। কোনো বেপরোয়ার জন্য কখনো পরিণতি ভালো হয় না। একটাও ভালো নিদর্শন নেই। রাষ্ট্র পরিচালনায় ধৈর্যশীল হওয়া প্রয়োজন। আমি খুবই নিবিড়ভাবে ভারতের মহীয়সী নারী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর উত্থান-পতন নিয়ে লেখাপড়া করেছি। ’৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ভারতীয় মানসপটে তাকে মা দুর্গা বা দেবী পার্বতীর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেই ইন্দিরা গান্ধীকেও জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে জনতা পার্টির কাছে পরাজিত হতে দেখেছি। তাই ক্ষমতা কোনো চিরস্থায়ী কিছু নয় এটা আমার চাইতে খুব বেশি ভালো করে কেউ জানে না। বর্তমান মাদকবিরোধী অভিযানে যদি জাতীয় সম্পৃক্ততা চাওয়া হয় তাহলে যত কষ্টই হোক আইনের মধ্যে থাকতে হবে। সঠিক বিচার এবং আইনের শক্তির কাছে বুলেট কিছুই না। একটি বুলেট একটি জীবন নষ্ট করতে পারে। কিন্তু কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না। যারা বুলেট ব্যবহার করে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের জীবন নষ্ট করে তাদের ভেবে দেখতে বলব তারা যত ক্ষমতাবানই হোন একটি পিঁপড়ার জীবন দিতে পারবেন না। তাহলে এত দেমাক কেন। আর যারা এসব করেন তারা নিজের গরিমা দেখালে এ দুনিয়াতেই একই রকম শাস্তি পাবেন এটা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি। সারা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সময় থাকতে সাবধান হোন। কার লেখাতে যেন পড়েছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময় এক পাকিস্তানি অফিসার ১৪ হাজার বাঙালি হত্যা করে ভারসাম্য হারিয়ে হাসপাতালে ছিল। মৃত্যুর মিছিল সবসময় তাকে তাড়া করত। কখনো ঘুমাতে দিত না। ওভাবেই ধাবমান মৃত্যু মিছিলের ভয়ে একদিন তাকে চলে যেতে হয়েছে। এত বড় যুদ্ধ গেছে যুদ্ধের বাইরে একটা পাতা নষ্ট হোক চিন্তা করিনি। চোখে দেখে একটা পিঁপড়ার গায়ে পা ফেলিনি। এখনো যখন গ্রামের বাড়িতে কোনো গাছের গোড়া পরিষ্কার করি, ঢাকার বাসায় এ-গাছ ও-গাছের পরিচর্যা করি তখন ভীষণ ভালো লাগে। তাই বলছি, হত্যা কোনো সমাধান নয়। হত্যার মনোভাব নিয়ে কেউ কোনো কাজ করে কোনো দিন সফল হয়নি। হত্যা করে ক্ষমতা দখল করা যায়, সিংহাসন দখল করা যায়। কিন্তু সফলতা অর্জন করা যায় না। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে হত্যার কী প্রয়োজন। ট্যাংকের পানির লাইন বন্ধ করে দিলে পানি পড়ার কোনো সুযোগ থাকে না। ইয়াবার রাস্তা বন্ধ করে দিলে ব্যবসার কোনো প্রশ্নই আসবে না। কেউ কেউ তো এও বলার চেষ্টা করছে, নেশার দাম বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য এ অভিযান নয় তো। কায়কারবার দেখে অস্বীকার করি কী করে। বহু বছর আগে এক গল্পে পড়েছিলাম, এক নৌবন্দরকে ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়েছিল। উজানের এক সওদাগরের সঙ্গে বন্দর কর্তৃপক্ষ দুর্ব্যবহার করায় হিমালয়ের কাছাকাছি সে নদীর মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছিল। কয়েক বছরেই সে বন্দর মরে শেষ হয়ে গিয়েছিল। নেশার লাইন ঘুরিয়ে দিতে পারলে সেই একই অবস্থা হতে পারে। তাই যেখানে গোড়ায় গলদ সেখানে মাথায় পানি না ঢেলে গোড়া খুঁজে বের করা দরকার। যেভাবে হত্যা করা হচ্ছে এর নিন্দা ছাড়া আর কিছু করা যায় না। হত্যা বন্ধ করে মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্তদের আইনের হাতে তুলে দিন। নিজেরা জড়িত না থাকলে দেখবেন আইনের হাত কত শক্ত, কত লম্বা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৫ মে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন ৪৬ হাজার বর্গফুটের বাংলাদেশ ভবনের শুভ উদ্বোধন করতে। ভারত বাংলাদেশের দুই প্রধানমন্ত্রী একসঙ্গে ভবনটির শুভ উদ্বোধন করেছেন। কাজটি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৬ হাজার কেন, আরও ৪৬ হাজার বর্গফুটের ভবন হলেও সরকার সাধুবাদ পেত। শান্তিনিকেতনে আমাদের ভূমিকা থাকা দরকার। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ শুধু ভারতের নন, পশ্চিমবঙ্গের নন, তিনি আমাদেরও। বিশেষ করে বাঙালি জাতির অবিচ্ছেদ্য সত্তা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সেই অর্থে বোলপুরের শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন এ এক অসাধারণ প্রয়াস। আমাদের কৃষ্টি-সভ্যতা মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শনে ভরা বাংলাদেশ ভবন হলেই চলবে না। প্রতি বছর সেখানে আমাদের অসংখ্য ছেলেমেয়ে পড়তে যায়, শিখতে যায়। তাদের সেখানে থাকা-খাওয়ার ভালোমন্দ ব্যবস্থা থাকা দরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিলাইদহ অথবা কুঠিবাড়ীতে কবিগুরুর নামে বিশ্ববিদ্যালয় করতে চেয়েছেন। এটাও খুবই ভালো কথা, প্রশংসনীয় উদ্যোগ। অনুষ্ঠানটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে প্রত্যক্ষ করেছি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেকটাই রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে চেয়েছেন। তিনি খুবই ভালো বলেছেন। তবে অন্য সরকার এলে ভারতকে পূর্ব-পশ্চিম দুই পাশেই পাকিস্তানের সঙ্গে ঘর করতে হবে কথাটি আমার ভালো লাগেনি। আমার মতো অনেক দেশপ্রেমিকের ভালো লাগেনি। আওয়ামী লীগ না থাকলে অথবা জননেত্রী শেখ হাসিনা না থাকলে আমরা পাকিস্তান হয়ে যাব, দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ কথা বলা খুব সম্মানের নয়। বরং মারাত্মক দৈন্যের। সে কাজটাই তিনি করেছেন। আমাদের দেশের সরকার কে হবেন, প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তা আমরা ঠিক করব। সেখানে ভারতের কী করার থাকতে পারে। কথাটি সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। তবু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সত্যিই ভালো ভাষণ দিয়েছেন। তার চাইতে চমৎকার ভাষণ দিয়েছেন ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এমন সাবলীল প্রাঞ্জল ভাষণ অভিজ্ঞ নেতাদের কণ্ঠে শোনা যায়। তার ভাষণে প্রতি পলে পলে মনে হয়েছে তিনি একজন যথার্থই নেতা। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক, বাংলাদেশের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসব কিছু যেভাবে তুলে ধরা দরকার সেভাবেই তুলে ধরেছেন। কোথাও বিন্দুমাত্র অঙ্গহানি হয়নি, খুঁত ধরা পড়েনি। আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। একজন আন্তর্জাতিক নেতার মতো তিনি তার ভাষণ দিয়েছেন। এজন্য আমরা অভিভূত। তাকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে সাধুবাদ জানাই। তিনি এও বলেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ’৪১ সাল পর্যন্ত যে লক্ষ্য স্থির করেছেন তার সেই লক্ষ্যের প্রতি আমাদের সমর্থন থাকবে।’ কথাটা বড় বেশি ব্যক্তিপর্যায়ে চলে গেছে। ২০১৮ সালে বলেছেন, ’৪১ সাল পর্যন্ত তার সমর্থন জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি থাকবে।’ কথাটা সর্বৈব অবাস্তব। গলায় গামছা নিয়ে বলতে পারি ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীদামোদর দাস নরেন্দ্র মোদি ’৪১ সাল পর্যন্ত ভারতের ক্ষমতায় থাকবেন না। বাংলাদেশের জননেত্রী শেখ হাসিনাও নন। বয়সের দিক থেকে শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদির চাইতে ১০-১২ বছরের বড়। স্বাভাবিক নিয়মেই তার শরীর তাকে সাহায্য করবে না। আর বাংলাদেশের মানুষ যাকে একবার বুকে তুলে মাথায় নেয়, তাকে কখনোসখনো পায়েও দলে। তাই এমন বলার খুব একটা মানে হয় না। তবে কথার কথা সভাসমিতির কথা হলে হতে পারে।
শ্রীমোরারজি দেশাই যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর চরম দুর্দিন তখন প্রথম বোলপুরের শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম ছোট বোন শুশুকে ভর্তি করতে। তখন ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন নেত্রকোনার রাজপরিবারের কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহের ভাতিজা সুরঞ্জিৎ সিংহ। তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। সে যাত্রায় তিনি আমার সঙ্গে দেখা দেননি। বলেছিলেন, ‘কীভাবে বাঘা সিদ্দিকী ভারতে আছেন তা না জেনে তিনি দেখা করতে পারেন না।’ আমার খারাপ লেগেছিল। ভারতের স্বাধীনতার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে রাসবিহারী বসু জাপানে গিয়েছিলেন। একসময় জাপানে থাকার প্রয়োজনে এক জাপানি মহিলা তাকে বিয়ে করেছিলেন। তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে জার্মানি থেকে নেতাজি সুভাষ বোসকে ডুবোজাহাজে সিঙ্গাপুর এনে সেই আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব দিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষ বোসের হাতে। সুদূর জাপানে একজন জাপানি মহিলা রাসবিহারী বোসকে আশ্রয় দিতে পারেন। কিন্তু নেত্রকোনার রাজপরিবারের সন্তান সুরঞ্জিত সিংহ বাঘা সিদ্দিকীর সঙ্গে সরকারি অনুমোদন ছাড়া দেখা করতে ভয় পান। এই হলো আমাদের আর জাপানিদের মধ্যে পার্থক্য। যেখানে ভাইস চ্যান্সেলরই অরাজি সেখানে বোনের ভর্তি হয় কী করে। সবকিছু ঠিকঠাক, ভারত সরকারের অনাপত্তি দরকার। কয়েকদিন পর গেলাম দিল্লি। ডেপুটি সেক্রেটারি মুচকুন্দ দুবে তখন বিএসএম বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা-মালদ্বীপ দেখেন। দিল্লি গিয়ে মুচকুন্দ দুবেকে ছোট বোনের শান্তিনিকেতনে ভর্তির কথা বলতেই দুই লাইনের এক চিঠি লিখে দিলেন। একটা আমার হাতে আরেকটা সরাসরি শান্তিনিকেতনে। পরের সপ্তাহে গেলাম শান্তিনিকেতনে। গিয়ে দেখি এলাহি কারবার। আমাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিশালায় জায়গা রাখা হয়েছে। ভাইস চ্যান্সেলর অপেক্ষা করছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। গৌর, বৌদ্ধ, রাজা, লুত্ফর, দুলাল ছিল আমার সঙ্গে। যাবার কয়েক মিনিটের মধ্যে ভর্তির কার্যক্রম সব শেষ। চার-পাঁচ শ টাকা লাগল। সব শেষ করে যখন ট্যুরিস্ট লজে ফিরলাম তখন ভাইস চ্যান্সেলরের লোক এসে হাজির। ভাইস চ্যান্সেলর দেখা করতে চান, কথা বলতে চান। আপনি বললে এখানে আসতেও তার কোনো আপত্তি নেই। বললাম, না, আসতে হবে না। সময়মতো আমিই গিয়ে দেখা করে আসব।
বোনকে রেখে বর্ধমানে ফিরছিলাম। বুকটা বড় খালি খালি লাগছিল। এর আগে কখনো শুশুকে বাইরের কোথাও রাখিনি। সেই প্রথম ঘরছাড়া। বাড়ি ফিরে মাকে বললে মা যেমন খুশি হলেন, তেমন তাকে বাড়ির বাইরে রেখে শূন্যতাও বোধ করছিলেন। এরপর কতবার গেছি শান্তিনিকেতনে। তখন এম আর আখতার মুকুলের স্ত্রী মাহমুদা খানম রেবা শান্তিনিকেতনে ছিলেন। কী নিদারুণ কষ্ট করেছেন। ওর মধ্যেই মাটির চুলায় রান্না করে আমাদের খাইয়েছেন। যে এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্রের জন্য একসময় ছিল বিশ্বজোড়া নাম বাংলাদেশের সর্বত্র প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি সেই এম আর আখতার মুকুল তখন ইংল্যান্ডে জুতার দোকানে চামড়া কেটে পেট চালাতেন। আর তার স্ত্রী মাহমুদা খানম রেবা নিদারুণ জ্বালা বুকে নিয়ে হতদরিদ্র অবস্থায় শান্তিনিকেতনে লেখাপড়া করতেন। এই ছিল তখন আমাদের নির্বাসিত জীবন। জননেত্রী শেখ হাসিনা থাকতেন দিল্লিতে আমি বর্ধমানে। কেউ কেউ কলকাতায়। আবার কেউ শান্তিনিকেতনে।
ঠিক সেই সময় বাংলাদেশের একঝাঁক শিল্পী শান্তিনিকেতনে লেখাপড়া করতে, গান শিখতে গিয়েছিল। সেখানে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, লীনা তাপসী, ডল, জামালপুরের নিঝু, শম্পা রেজা আরও অনেকে। সে ছিল এক অভাবনীয় দুঃখ-আনন্দের দিন। আমি যখন বর্ধমানে ছিলাম তখন হুমায়রা চুমকির বাবা এমদাদ আলী বাবু আমাদের সঙ্গে খুবই ওঠাবসা করতেন। একসময় চুমকি শান্তিনিকেতনে ভর্তি হয়। চুমকি আমাদের সবার খুবই পছন্দের ছিল। মুরাদের জন্য আমরা ওকে পছন্দও করেছিলাম। চুমকি শান্তিনিকেতনে থাকতে যে কবার গেছি কী অসাধারণ গাইডের কাজ করেছে। খুব অবাক লাগত তার আন্তরিকতা আর দক্ষতা দেখে। শান্তিনিকেতনের সব ছিল আমার চেনা। চুমকির আগে কতবার গেছি। কিন্তু তবু চুমকি যখন আমাদের নিয়ে ঘুরত এক আলাদা আবহাওয়ার সৃষ্টি হতো, ভালো লাগত, আনন্দ পাওয়া যেত, সেই শান্তিনিকেতনে প্রধানমন্ত্রীর সফর ২৫ কোটি টাকায় বাংলাদেশ ভবন নির্মাণ এবং দুই দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তা উদ্বোধন— এক ঐতিহাসিক ঘটনা। সে ঘটনায় সাক্ষী হতে পারলাম না। যারা সাক্ষী হিসেবে গিয়েছিলেন তাদের কারোরই তেমন শান্তিনিকেতনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই, যোগাযোগ নেই। সৌজন্যে : বিডি প্রতিদিন
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন