মিয়ানমারে গণতন্ত্রঃ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নয়, মিয়ানমারের জনগণের হাতে

১ ফেব্রুয়ারী ২০২১-এ মিয়ানমারে ঘটে যাওয়া সামরিক অভ্যুত্থানের স্মরণে, আজ ৩১ জানুয়ারী, ২০২২ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইন্সিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্স (এসআইপিজি)’র অধীন সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ (সিপিএস) “মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার: সামরিক অভ্যুত্থানের এক বছর” শীর্ষক একটি ওয়েবিনার আয়োজন করে।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) এর ফ্যাকাল্টি, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. শাফাত আহমেদ (অব.) এই ওয়েবিনার এর প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তার বক্তব্যে তিনি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামরিক বাহিনী, তাতমাদও’র ইতিহাস এবং এর কৌশলগত সংস্কৃতির বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। এছাড়াও মিয়ানমার ভূখণ্ডে চীন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আসিয়ানের (ASEAN) স্বার্থসহ এর ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়েও আলোচনা করেন। তিনি বলেন, তাতমাদও তার প্রতিরক্ষা কূটনীতির মাধ্যমে মিয়ানমারের বৈদেশিক সম্পর্কের সবচেয়ে সক্রিয় খেলোয়াড় হিসেবে ভুমিকা রাখছে। তিনি আরও বলেন যে কোনও দেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে চায় না, কারণ এই হস্তক্ষেপ প্রকারন্তরে সব ধরণের আন্তর্জাতিক আইন ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জটিলতা বাড়ায়। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে বর্তমানে তাতমাদও’র বিরুদ্ধে সামরিক শাসন বিরোধীদের বিজয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ যার ফলে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাও ঝুঁকির মধ্যে আছে। তিনি পরিশেষে মত দেন যে শুধুমাত্র মিয়ানমারের জনগণই মিয়ানমারকে পরিবর্তন করতে পারে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে তা খুবই কঠিন হতে যাচ্ছে।

এনএসইউ’র রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান এই ওয়েবিনারের একজন আলোচক ছিলেন। তিনি বলেন যে মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আন্তর্জাতিক ব্যর্থতা তার জনগণের জন্য নেতিবাচক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। সুতরাং, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই সেখানে শান্তি আনতে গণতন্ত্রপন্থী এনইউজি (NUG) সরকারকে সমর্থন ও বৈধতা দিতে হবে।

মালয়েশিয়ার সুলতান জয়নাল আবিদীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মাহবুবুল হক মায়ানমারের রাষ্ট্র-নির্মাণ প্রক্রিয়ার অন্তর্নিহিত বিষয়গুলির উপর তার মূল্যবান মন্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন যে বাংলাদেশ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যার সবচেয়ে বেশি শিকার কিন্তু এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের ভূমিকা খুবই কম। বর্তমানে সেনা অভ্যুত্থানের পর রোহিঙ্গা সংকট কিছুটা হলেও বৈশ্বিক মনোযোগ হারিয়েছে। তিনি মিয়ানমারের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আশা কম দেখেন কারণ বিভক্ত আসিয়ান এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করছে না।

অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং ফিজিতে নিযুক্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে সরকারের মাননীয় হাইকমিশনার রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমান মিয়ানমারের চলমান চ্যালেঞ্জের সমাধানে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার গুরুত্বের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন বাংলাদেশকে নীরব থাকার পরিবর্তে পশ্চিমা ও উত্তরের দেশগুলোর কাছে এর অসন্তোষ প্রকাশ করতে হবে।

বাংলাদেশ সরকারের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব রাষ্ট্রদূত জনাব শহীদুল হক, বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসআইপিজির প্রফেসোরিয়াল ফেলো ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, এখন মনে হচ্ছে মিয়ানমার রাষ্ট্রের একটি সামরিক বাহিনী নেই বরং সেনাবাহিনীর একটি রাষ্ট্র আছে। তিনি আরও মত দেন যে মিয়ানমারে বর্তমান অস্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে এবং আলোচনার জন্য সমস্ত জানালা খোলা রাখা জরুরি, বিশেষ করে এনইউজি (NUG)’র সাথে। পরিশেষে তিনি বলেন যে আমাদের অবশ্যই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আশা করতে হবে কারণ সেদেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ক্ষমতায়নে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে।

সিপিএস-এর সমন্বয়ক এবং এনএসইউ’এর সহকারী অধ্যাপক ড. আব্দুল ওহাবের উদ্বোধনী বক্তৃতার মাধ্যমে ওয়েবিনারটি শুরু হয়। এবং সিপিএস-এর সদস্য এবং এনএসইউ’এর সহকারী অধ্যাপক ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানার ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি শেষ হয়। ওয়েবিনারে শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, কূটনীতিক, সাংবাদিক, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজন এবং বাংলাদেশী ও বিদেশি শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।