যশোরের বেনাপোল বন্দরে পণ্য আমদানিতে অভাবনীয় গতি ফিরেছে
পশ্চিমবঙ্গে ‘অনলাইন ¯øট বুকিং সিস্টেম’ চালু হওয়ায় বেনাপোল বন্দরে পণ্য আমদানিতে অভাবনীয় গতি এসেছে। আগে আমদানি পণ্য দেশে প্রবেশ করতে পেট্রাপোলে ৩০ থেকে ৪০ দিন অপেক্ষা করতে হতো।
গুণতে হতো বাড়তি ডিটেনশন চার্জ ও গোডাউন ভাড়া। আমদানিকারকদের মতে, এই খাতে বছরে বাড়তি ব্যয় হতো প্রায় হাজার কোটি টাকা। এখন ৩ দিনেই পেট্রাপোল থেকে বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করছে ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক। ফলে দ্রæততম সময়ে পণ্য আমদানির পাশাপাশি সাশ্রয় হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।
পেট্রাপোল সুত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের স্থলবন্দরগুলো দিয়ে ট্রাকে পণ্য রফতানি সংক্রান্ত কাজে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে সম্প্রতি পরিবহন দফতর অনলাইন স্লট বুকিং সিস্টেম বা সুবিধা ভেহিকেলস ফেসিলিয়েশন সিস্টেম চালু করেছে।
পুরানো ব্যবস্থায় বাইরের রাজ্য থেকে আসা পণ্যবাহী ট্রাক পেট্রাপোল বন্দরে যাওয়ার আগে বনগাঁ শহরের তিনটি জায়গায় (কালীতলা, কালীবাড়ি মোড় এবং বিএসএফ ক্যাম্প মোড়) পরিবহন দফতরের কাছে এন্ট্রি করাতো। তারপর সীমান্তে যাওয়ার জন্য ছাড়পত্রের জন্য অপেক্ষা করতো। এই ছাড়পত্র মিলতে একমাস বা তারও বেশি সময় লাগতো। ততদিন ট্রাকের মালামাল স্থানীয় গোডাউন বা স্থানীয় ট্রাকে তুলে বেসরকারি পার্কিং লটে রাখা হতো। বাইরে থেকে আসা বেশিরভাগ ট্রাক বনগাঁয় পণ্য নামিয়ে ফিরে যেত। এ কারণে বনগাঁয় বহু সংখ্যক গোডাউন এবং পার্কিং লট রয়েছে।
বনগাঁর পার্কিং ও গোডাউন ঘিরে এই সিন্ডিকেটকে কালীতলা সিন্ডিকেটও বলা হয়। এই চক্রে ৩০ থেকে ৪০ দিন আটকে থেকে পণ্যবোঝাই প্রতি ট্রাককে গড়ে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা বাড়তি গুণতে হতো। বছরে যা প্রায় হাজার কোটি টাকা।
ওপারের পরিবহন দফতরের তথ্য অনুযায়ী, নতুন ব্যবস্থাপনায় ভারতের যেকোনো প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে ট্রাকে পণ্য পরিবহনের জন্য আগেভাগেই অনলাইনে ‘স্লট বুকিং’ করতে পারবেন। এই কাজে চেসিসের জন্য লাগবে ৫ হাজার টাকা এবং পণ্য বোঝাই ট্রাকের জন্য ১০ হাজার টাকা। নতুন এই ব্যবস্থাপনায় ভেঙে গেছে কালীতলা পার্কিং সিন্ডিকেট।
আমদানি বাণিজ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার বনগাঁ কালিতলা পার্কিং সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে অনলাইনে স্লট বুকিং চালু করায় ভারতের যেকোনো প্রদেশ হতে ট্রাক কোলকাতায় এসে পৌঁছানোর পর ১-২ দিনের মধ্যে বেনাপোলে পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে খুশি ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, উভয় দেশের সরকারি কর্মকর্তারা বিশেষ করে ভারতীয় পরিবহন দপ্তর, বন্দর কাস্টমস এবং বেনাপোল কাস্টমস্ ও পোর্ট এলপিআই নিয়মিত তদারকি করলে ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশে বনগাঁ পার্কিং সিন্ডিকেটের ডিটেনশন চিরতরে হারিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ-ভারত চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মতিয়ার রহমান জানান, বাংলাদেশের প্রতিটি আমদানিকারক ঋণপত্র খোলার সময় পণ্যের মুল্যের সঙ্গে বনগাঁ, কালিতলা পার্কিংয়ের ৩০-৩৫ দিনের ট্রাক ডিটেনশন চার্জ ও মালবাহী ট্রাক চার্জ উলেখ করে তার ওপর আমদানিকারককে শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। গত এক দশক ধরে প্রতি বছর প্রায় হাজার কোটি টাকা শুধু কালিতলা পার্কিং ও ডিটেনশন চার্জ বাবদ দেওয়া হয়েছে।
শুধু তাই নয়, দিলি, মুম্বাই অথবা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে একটি ট্রাক পেট্রাপোলে আসার পর পণ্য লোকাল গোডাউনে আনলোড করে রাখতো। পরবর্তীতে সেই একই পণ্য দুইটি ট্রাকে লোড করে বেনাপোলে পাঠানো হতো যা ঋণপত্রের শর্ত বহির্ভ‚ত। এলসিতে পার্ট শিপমেন্ট অনুমোদন থাকলেও ট্রান্স শিপমেন্টের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকে। বনগাঁ পার্কিং সিন্ডিকেট ট্রাকের ভুয়া নম্বর দিয়ে এন্ট্রি করে রাখা হতো। পরবর্তীতে সেই সিরিয়াল নম্বর পঞ্চাশ হাজার টাকায়ও বিক্রি করা হতো বলে জানান তিনি।
বেনাপোল বন্দরের আমদানি রফতানি সমিতির সহ-সভাপতি আমিনুল হক বলেন, একটা সময় কোনো পণ্যবাহী ট্রাক এন্ট্রি নেওয়ার পর ৩০ থেকে ৪০ দিন আটকে থাকতে হতো। তারপরও দালালদের টাকা দিয়ে পণ্য দেশে ঢুকতো। এই পুরানো ব্যবস্থা পাল্টাতে মাস্টার স্ট্রোক দেয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। পৌরসভার হাত থেকে পার্কিং নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়ে তা তুলে দেওয়া হয় পরিবহন দপ্তরের হাতে। নয়া সিদ্ধান্তের পর দেখা গেছে, জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে আটকে থাকা গাড়ির সংখ্যা ও দিন অনেক হ্রাস পেয়েছে। এখন ৩০-৪০ দিন নয়, তা কমে ৩দিনে নেমে এসেছে। কোনো কোনো গাড়ি এন্ট্রি হওয়ার দিনই ঢুকছে বাংলাদেশে। ফলে অভাবনীয় গতি এসেছে পণ্য আমদানিতে; স্বস্তি ফিরেছে বাণিজ্যে।
সিঅ্যন্ডএফ ব্যবসায়ী খায়রুজ্জামান জানান, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এমন পদক্ষেপে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে আমদানিকারকদের মাঝে। দ্রæত পরিবহন করা যাচ্ছে পণ্য।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ স্টাফ অ্যাসোসিয়েশন সহ-সভাপতি কামাল হোসেন জানান, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এমন উদ্যোগে দুই দেশের ব্যবসায়ীরাই খুশি। তবে ট্রাক প্রতি সেবা চার্জ ১০ হাজার রুপি ও ট্রাক চ্যাচিজ চার্জ ৫ হাজার রুপি নির্ধারণ করা হয়েছে। এই চার্জ কিছুটা কমালে আরো উপকৃত হবেন ব্যবসায়ীরা।
পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, ভুয়া এন্ট্রি বন্ধ হওয়ায় এখন দুই থেকে তিনদিনের মধ্যে গাড়ি বাংলাদেশ পৌঁছে যাচ্ছে। আগামী দিনে এই বন্দরে কাজের পরিমাণও বাড়বে। রপ্তানি বাণিজ্য করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীদের উৎসাহ বাড়বে বলে মনে করছেন শুল্কদপ্তরের আধিকারিকরা।
বেনাপোল বন্দরের উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর তরফদার বলেন, ওপারে ‘অনলাইন স্লট বুকিং সিস্টেম’ চালু হওয়ায় পণ্য আমদানিতে দীর্ঘতা কেটেছে। দুই দেশের সরকারের চেষ্টায় ভারতের রাজ্য সরকারের এই নতুন নির্দেশে পেট্রাপোলের আমদানি বাণিজ্যে গতি এসেছে, গতি এসেছে বেনাপোলেও। আমরা আশাবাদী আমদানি-রফতানি বাণিজ্য আরো গতিশীল হবে, ব্যবসায়ীরা পেট্রাপোল-বেনাপোল বন্দর ব্যবহারে আরো আগ্রহী হবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন