রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন কেন সবসময় মিয়ানমারের পক্ষে?
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিষয়টিতে সবসময়ই জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের বিরোধী চীন, এবং সর্বদাই তারা মিয়ানমারের পক্ষে। এটার কৌশলগত কারণটা আসলে কী? কী তার স্বার্থ?
গত বছরের আগস্ট মাসে রাখাইন প্রদেশে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযান ও নির্যাতনের মুখে সাত লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। খবর: বিবিসি বাংলা
জাতিসংঘের বিশেষ তথ্য অনুসন্ধানী কমিটির প্রধান মারযুকি দারুসমান বুধবার নিরাপত্তা পরিষদে দেয়া এক রিপোর্টে বলছেন, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে এখনও গণহত্যা চলছে। এখনও যে প্রায় চার লক্ষ রোহিঙ্গা রাখাইনে রয়ে গেছেন- তারা নানা ধরনের অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন।
কিন্তু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এ নিয়ে যে পদক্ষেপই নিতে চেষ্টা করুক না কেন, তাতে বাধ সাধে স্থায়ী সদস্য চীন, তার সাথে রাশিয়াও। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন কেন জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করছে? কী তার স্বার্থ?
মালয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চায়না স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলীকে এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলছেন, চীনের প্রধান স্বার্থ দুটি।
ড. আলি বলেন, এর একটি হলো অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার পক্ষে তাদের চিরাচরিত পররাষ্ট্রনীতি- যার পাশাপাশি চীন চায় যে তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও অন্য কোনো দেশ হস্তক্ষেপ না করুক।
‘আর অপরটি হচ্ছে, তাদের কৌশলগত ও বাণিজ্যিক স্বার্থ- যার মূল কথা: তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও তেল-গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য মালাক্কা প্রণালী ছাড়াও মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে আরেকটি স্থলপথকে অক্ষুণ্ণ রাখা।’
চীনের এই নীতির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে ড. আলি বলেন, রোহিঙ্গা প্রশ্নে তারা ২০১৭ সাল থেকেই বলে আসছে যে চীন ও বাংলাদেশের সরকারকেই আলোচনার মাধ্যমে একটা সমাধান করতে হবে- বাইরের কোন শক্তির হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে না, কারণ তাতে সমস্যার সমাধান হবে না।
ড. আলি বলেন, চীনের নিজস্ব সমস্যা রয়েছে। তিব্বত বা শিনজিয়াং- এই দুই প্রদেশের অন্য জাতিগোষ্ঠীর লোক বাস করে এবং তাদের সাথে বহু দশক ধরে চীনের সংখ্যাগরিষ্ঠ হান সম্প্রদায়ের সংঘাত চলছে। চীন সরকার এই অঞ্চলগুলোকে শান্ত করার জন্য বেশ কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।
এ নীতি দেখিয়েই তারা চাইছে, অন্য দেশগুলো চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করুক।
‘এটা হচ্ছে একটি দিক। অন্য আরেকটি বিষয় ভুললে চলবে না যে বহু দশক ধরে মিয়ানমার চীনের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। এর অনেক কারণ- তবে একটির কথা আমি বলতে চাই।’
সৈয়দ মাহমুদ আলির কথায়, ‘গত দু’দশক ধরে চীনের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ বাণিজ্য সমুদ্রপথে হচ্ছে। সেই বাণিজ্য মালাক্কা প্রণালী দিয়ে হয় এবং চীন জানে যে তার সাথে শত্রুভাবাপন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং তার আঞ্চলিক মিত্ররা চাইলেই চীনের বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে পারে। এটাকেই বলে চীনের মালাক্কা সংকট।’
‘এখন বাণিজ্য পথ খোলা রাখার জন্য চীন যদি সেখানে নৌবাহিনী পাঠায়- তাহলে সংকট আরো ঘনীভূত হবে- যাকে বলে চীনের মালাক্কা ডাইলেমা।’
‘সেই মালাক্কা সংকটের কথা মাথায় রেখেই চীন স্থলপথে বিভিন্ন পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল এবং গ্যাস যাতে চীনে পৌছাতে পারে- তার ব্যবস্থা করেছে। এরকম দুটি পাইপলাইন আরাকান অর্থাৎ মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে পৌঁছেছে।’
ভারতেরও এ ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে কালাদান এবং সিটওয়ে বন্দরে- কিন্তু চীনের অর্থনীতির জন্য এ দুটি পাইপলাইন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
সে জন্যই চীন চাইছে না যে মিয়ানমার সরকার যেন আরাকানের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারায়, বা আরাকানকে কেন্দ্র করে চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক খারাপ হোক।
অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার চীনের যে নীতি- তার সূচনা কিভাবে হয়েছিল তা ব্যাখ্যা করে ড. আলি বলেন, তিব্বতে ১৯৫৪ সালে যখন গৃহযুদ্ধ চলছিল- যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত তখন তিব্বতী যোদ্ধাদের সমর্থন দিচ্ছিল। সেই যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্য নিয়ে চীন এবং ভারত সরকার ১৯৫৪ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। সেই চুক্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাঁচটি আদর্শের কথা বলা হয়েছিল। তার প্রথমটি ছিল- কোন দেশই অন্য কোন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। জাতিসংঘের সনদেও এমনটা লেখা আছে।
‘১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং-এ আফ্রিকান এবং এশিয়ান দেশগুলোর এক সম্মেলনে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সূচনা হয়। সেখানেও বলা হয়েছিল, এই আদর্শগুলোকে অনুসরণ করেই জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোকে পরস্পরের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে। চীন আনুষ্ঠানিকভাবে এই পাঁচটি নীতিমালা এখনো বজায় রেখেছে, সেকারণেই তারা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে অন্তত আনুষ্ঠানিকভাবে চাইছে না। মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও তাই প্রযোজ্য।’
তাহলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে আসল চাবিকাঠি কার হাতে?
জবাবে সৈয়দ মাহমুদ আলি বলেন, লক্ষ্য করার বিষয় যে অন্য ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও রোহিঙ্গা বা মিয়ানমার বিষয়ে তাদের নীতি মোটামুটি একই রকম।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ যদি আলোচনার মাধ্যমে মিয়ানমারের সাথে এ সংকটের সমাধানে আগ্রহী হয়- তাহলে আমার মনে হয় বাংলাদেশের দুটি বন্ধু রাষ্ট্র ভারত ও চীন- এই দুই রাষ্ট্রের সহযোগিতার মাধ্যমেই মিয়ানমারের সাথে আলোচনা করা সম্ভব।’
কিন্তু ভারত এবং চীনকে বাদ দিয়ে এ সংকটের সমাধান সম্ভব বলে আমার মনে হয় না- বলেন তিনি।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন