লকডাউন ও আমজনতা
লকডাউন চলছে, সাথে হঠাৎ করে চালু হলো শাটডাউন। বাঁশি বাজিয়ে, হর্ন বাজিয়ে, দেশের সামরিক, আধা-সামরিক, বেসামরিক বাহিনী আম জনতাকে জানান দিয়ে রাস্তায় নামল। মানুষ দেখলো, কেউ পেটের দায়ে কেউবা শাটডাউন দেখতে এসে লাঠির পেদানি খেলো। আবার কেউ জরিমানা গুনলো। লকডাউন আর শাটডাউন সীমিত পরিসরে আর সীমাহীন পরিসরে যাই বলি না কেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতেই হবে। আর না রাখলে যা হবার তাই হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এই অতি ঘনবসতিপূর্ণ ছোট মাতৃভূমির আম জনতার কথা যদি ভাবি, তাহলে বাস্তবতার আলোকে কি দেখি, এ প্রসঙ্গে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতার একটা ঘটনা দিয়ে আজকের লেখা শুরু করব।
আমার বাড়ির গৃহপরিচারিকা না গৃহ সহায়িকা বলবো ভেবে পাচ্ছিনা। কারণ আগেকার অফিসের এম এল এস এস এখন হয়েছে অফিস সহায়ক মহামারী হয়েছে অতি মহামারি তাই ভাবছি গৃহপরিচারিকা বলবো না গৃহ সহায়িকা, আমার মনে হয় আগামীতে গৃহপরিচারিকা বলি আর গৃহ সহায়িকা বলি এই কাজ করতে গেলেও ডিপ্লোমাধারী হতে হবে। যাই হোক ভবিষ্যতের ভাবনা রেখে দাদা- দাদি-নানিদের অনুসরণ করে আমি গৃহপরিচালিকা বলি ।
আমার বাড়ির গৃহপরিচারিকা ১০ বছর থাকার পর ওর বাবা একদিন এসে রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে আমার মায়ের সাথে কথা বলল। তিনি আমার মাকে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললেন, মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য একটা ভাল পাত্র পাওয়া গেছে, ছেলে খুব ভালো। জমিজমা নেই অন্যের পুকুরের ধারে বাস করে। তবে ভ্যান গাড়ি চালিয়ে ভালো পয়সা কামাই করে। এই পাত্র হাতছাড়া হলে এমন ভালো পাত্র আর পাওয়া সম্ভব হবে না। মা উনার কথা শুনে সম্মতি দিলেন এবং ওই বিয়ের সমস্ত খরচ বহনের জন্য আমাকে নির্দেশ দিলেন। আমি বিয়ের দিন সকালে ওদের বাড়ি হাজির হই। ছোট্ট একটি ঘর মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়, একটি ছোট্ট বারান্দা সেখানে ছোট একটি চারপায়া ওদের ভাষায় সেটিকে খাট বলে। আমার মনে হল আমাকে বসানোর জন্য হয়তো আজকে এটি আনা হয়েছে। তাদের সাধ্যমতো দুপুরে আমাকে খাওয়ানো হলো। যেহেতু রাতে বিয়ে তাই দুপুরে খাওয়ার পর পাড়ার মাতব্বর সহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আমাকে নিয়ে আলোচনায় বসলো। আলোচনা শেষে আমাকে জানানো হল ৩৫০০ টাকা হলে আজকে রাতে বিয়ের কাজটি ধুমধামের সাথে সম্পন্ন হবে। এরপরের অংশটুকু নাইবা বলি, এটাই হচ্ছে আমাদের গ্রাম বাংলার অসহায় নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষগুলোর জীবনযাত্রার মান। তাদের একদিন কাজ করলে খাওয়া হয় আর না করলে উপোস থাকতে হয় । রোগ শোক বোধহয় ওদের স্পর্শ করতে সাহস পায় না।
কাঠমিস্ত্রি বাবলু সে আমার নিকট আসছে স্যার ওদের একটু বলে দেন ,আমি যেন ঘরের দরজা বন্ধ করে কাজ করতে পারি। ঋণ নিয়ে গাছ কিনেছি ফার্নিচার তৈরি করে গ্রাহককে না দিতে পারলে ঋণের কিস্তি শোধ করতে পারব না স্যার। একটু বলে দেন কি আকুতি! অন্যদিকে আমার মতো সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী মানুষগুলো লকডাউন, শাটডাউন নাইট উৎসব হিসেবে পালন করছে। খাবারের মেনু দেখে অনলাইনে অর্ডার করছে রকমারি সব বাহারি খাবার। কখনো বাড়ির কাজের বুয়াকে ইলিশ খিচুড়ি ব্যবস্থা করার কথা বলে বন্ধুবান্ধব নিয়ে লকডাউন শাটডাউনের অলস সময়ে তাস, দাবা ,কেরাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর চায়ের কাপে সরকারের সফলতা ব্যর্থতা মুর্খ আমজনতার জ্ঞানের অভাবের জন্য দেশটা শ্মশানে পরিণত হবে বলে ঝড় তুলছে।
আসলে আমরা যারা সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছি আমরা কি কখনো ভেবেছি যারা আমাদের খাদ্য জোগায় যাদের কারণে আমরা বিলাসী জীবনযাপন করছি, সেই কৃষক, শ্রমিক, ভ্যানওয়ালা, রিক্সাওয়ালা, কাঠমিস্ত্রি তথা নিম্নআয়ের কর্মজীবী মানুষের কথা কখনো ভেবেছি? আমরা কি কখনো কল্পনাও করতে পারি মাত্র ৩৫০০ টাকায় মহা ধুমধামের সাথে মেয়ে বিয়ে দেওয়া যায়? তাই বলি কি, লকডাউন, শাটডাউন অমান্য করার কারণে ঐ সমস্ত পরিশ্রমী নিম্ন আয়ের মানুষগুলোকে ভৎর্সনা না করে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির কথা ভাবি তাহলে সবকিছুই সার্থক হবে। না হলে শেষ বিচারে হয়তো আমরা কেউই পরিত্রাণ পাবো না।
লেখক :
আখতার আসাদুজ্জামান চান্দু
প্রধান শিক্ষক, সোনাবাড়ীয়া সম্মিলিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলারোয়া, সাতক্ষীরা।
সভাপতি, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, কলারোয়া, সাতক্ষীরা।
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ স্কাউটস্, কলারোয়া উপজেলা, সাতক্ষীরা।
মুঠোফোন : ০১৭১৬-৪৯৫৪৯৮
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন