শুধু ধর্মীয় কারণে নয়, রোহিঙ্গা নির্যাতনের নেপথ্যে রয়েছে এই চার উদ্দেশ্য
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাস্তুচ্যুত মানুষগুলো নির্যাতন থেকে বাঁচতে আশ্রয়ের খোজে পায়ে হেটে অথবা নৌকায় চড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে।
এই সহিংসতার পেছনে অনেকেই ধর্মীয় ও জাতিগত বৈষম্যকে দায়ী করেছেন। তবে সময় যত গড়াচ্ছে ততই আরও বেশি মনে হচ্ছে যে এর পেছনে আরও কোন কারণ নিহিত রয়েছে। কারণ মিয়ানমারে ১৩৫টি সরকার স্বীকৃত সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে। তবে ১৯৮২ সালে এই তালিকা থেকে রোহিঙ্গাদেরকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়।
সাম্প্রতিক এই সহিংসতা বিশ্লেষণ করার সময়, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো সামরিক বাহিনী ও মিয়ানমারের কার্যত নেত্রী অং সান সুচির দিকেই বেশি নজর দিয়েছে। নতুন করে সহিংসতা শুরুর পর থেকেই শান্তিতে একজন নোবেলজয়ী হিসেবে এই পরিস্থিতি সামলাতে তার ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে বারবার।
এখনও পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ওপর এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিন্দা জানান নি তিনি। ক্লান্ত হয়ে গণমাধ্যমের নজর রোহিঙ্গাদের দুর্দশার দিকে পড়েছে। তবে এখনও এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছেনা। এই নিপীড়নের মূল কারণ হিসেবে শুধু ধর্মীয় ও জাতিগত বৈষম্য ছাড়া আর কোনকিছু দায়ী কি না তা খুজে দেখাটাও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
মিয়ানমার থেকে শুধু রোহিঙ্গা নয়, কাচিন, দ্য শান, দ্য কারেন, দ্য চিন ও দ্য মোনের মতন অন্যান্য গোষ্ঠীর সদস্যরাও বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন। আমাদেরকে অবশ্যই এর পেছনে ব্যাপক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকার বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে।
ভূমি দখল : মিয়ানমারে ব্যাপক পরিমাণে ভূমি দখল ও জব্দ করা হয়। এটা নতুন কিছু নয়। ১৯৯০ সালে থেকেই দেশটির সামরিক জান্তারা ধর্ম- জাত নির্বিশেষে কোন ক্ষতিপূরণ ছাড়াই দেশজুড়ে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জোতদারদের জমি জব্দ করে নিচ্ছে। প্রায়শই বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্যে ভূমি দখল করা হয়ে থাকে।
এসব প্রকল্পের মধ্যে, সামরিক ঘাটির বিস্তার ঘটানো, প্রাকৃতিক সম্পদ নিষ্কাশন ও শোষণ, বড় ধরণের কৃষি প্রকল্প, অবকাঠামো ও পর্যটন প্রকল্পও অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, কাচিন রাজ্যের গ্রামবাসীদের কাছ থেকে ব্যাপক পরিমাণের স্বর্ণ খননের স্বার্থে ৫০০ একর জমি জব্দ করে নিয়েছে সামরিক বাহিনী।
উন্নয়নের স্বার্থে সহস্র মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে- অভ্যন্তরীনভাবে এবং বাংলাদেশ, ভারত ও থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতেও-অথবা তাদেরকে বাধ্য করা হয়েছে সমুদ্রপথে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া চলে যেতে। ২০১১ সালে মিয়ানমার বিদেশি বিনিয়োগ গ্রহণ করা শুরু করে।
দেশটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্করণের ফলে এটি এশিয়ার চূড়ান্ত সীমানা( এশিয়া’স ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার) হিসেবে পরিচিতি পায়। এর কিছু সময় পর, ২০১২ সালে রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়- আর অল্প পরিসরে মুসলিম কারেনদের ওপরেও। এর মাঝে মিয়ানমার সরকার, কৃষিজমির ব্যবস্থাপনা ও বণ্টন সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি আইনও প্রতিষ্ঠা করে।
আইনগুলো বড় বড় কর্পোরেশনগুলোকে জমি দখল করে লাভবান হওয়ার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়ার দায়ে তীব্রভাবে সমালোচিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, কৃষি ব্যবসা বিষয়ক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী ‘পিওএসসিও দায়েও’ সরকারী যোগাযোগের মাধ্যমে আগ্রহ নিয়ে এই মার্কেটে প্রবেশ করে।
একটি আঞ্চলিক পুরস্কার : মিয়ানমার এমন কিছু দেশের মাঝখানে অবস্থান করছে যে দেশগুলো বহুদিন ধরে এর প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আগ্রহ দেখিয়ে আসছে- যেমন চীন ও ভারত। ১৯৯০ সাল থেকে চীনা কোম্পানীগুলো মিয়ানমারের শান রাজ্যের বাশ, নদী ও খনিজ সম্পদ নিয়ে ঘাটাঘাটি করে আসছে।
এ নিয়ে তৎকালীন সামরিক সরকারের সঙ্গে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট অর্গানাইজেশন ও এর জাতিগত মিত্র সংগঠনসহ কাচিন ও শান রাজ্যের অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীগুলোর সহিংসতার সৃষ্টি হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে চীন ও ভারতের আগ্রহ হচ্ছে আরও বিস্তৃত চীন-ভারত সম্পর্কের একটি অংশ। এই আগ্রহ মূলত মিয়ানমারজুড়ে বিভিন্ন অবকাঠামো ও পাইপলাইন নির্মানের চারপাশেই ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে।
এই ধরণের প্রকল্পগুলো পুরো মিয়ানমারের জন্যে চাকরী, পরিবহণ ফি, তেল ও গ্যাস রাজস্ব নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। এরকম বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের মধ্যে, ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাখাইন প্রদেশের রাজধানী সিত্তুয়ি শহর থেকে চীনের কানমিং শহর পর্যন্ত একটি বহুজাতিক পাইপলাইন নির্মানের কাজ শুরু করে চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন।
মিয়ানমার থেকে চীনের গুয়াংঝো শহরে অবস্থিত শুই গ্যাসক্ষেত্রে তেল ও গ্যাস নেওয়ার ব্যাপক চেষ্টার কথা বেশ ভালোভাবেই নত্থিভুক্ত আছে। এছাড়া মিয়ানমারের কিয়ায়ুখফিয়ু বন্দর থেকে একটি সমান্তরাল পাইপলাইন চীনে মধ্য-প্রাচ্যীয় তেল সরবরাহ করার সম্ভাবনাও রয়েছে।
তবে, দ্য এডভাইজোরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট মিয়ানমার সরকারকে এর প্রভাব সুষ্ঠুভাবে বিবেচনা করার আহবান জানিয়েছে। এমনকি এই নিরপেক্ষ কমিশনটি এটাও বলেছে যে, এই পাইপলাইন স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোকে ঝুকির মধ্যে ফেলবে। স্থানীয়দের মধ্যে জমি বাজেয়াপ্তকরণ, অপর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ, পরিবেশগত অবনতি ও স্থানীয়দের কাজ করার সুযোগ দেয়ার বদলে বিদেশী কর্মী নিয়োগ দেয়ার মতো বিষয় নিয়ে ভয় কাজ করছে।
এদিকে কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্টেশোন প্রকল্পের অংশ হিসেবে সিত্তুয়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মান ও অর্থায়ন করেছে ভারত। উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের সংযোগ ঘটানো। রাখাইন রাজ্যের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো পরিষ্কারভাবেই চীন ও ভারত উভয়ের কাছেই কৌশলগত কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
আর মিয়ানমার সরকার তাই ভবিষ্যত উন্নয়ন ও দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গতি বৃদ্ধির খাতিরে অঞ্চলটির ভূমি পরিষ্কার করার দিকে দেখাচ্ছেন। এর সবকিছুই ভূ-রাজনৈতিক চাল চালার এক বৃহত্তর প্রেক্ষাপটের ভেতরে ঘটছে। এসবের মাঝে জাতিগত উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়ায় বাংলাদেশের ভূমিকাও বেশ আপত্তিকর। ক্ষমতার এরকম সংগ্রামে, মানবিক ক্ষতি অপূরণীয়।
সংখ্যালঘুদের দুর্বলতা জোরদার করা : মিয়ানমারে যে গোষ্ঠীগুলো জমি দখলের খপ্পরে পড়েছে সেগুলোর বেশিরভাগের শুরুই চরম পর্যায়ের অসহায়ত্ব দিয়ে হয়েছে। আর শেষ হয়েছে আরও খারাপ পরিস্থিতি দিয়ে। মিয়ানমারে সংখ্যালঘুদের ওপর যে ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নির্যাতন।
যখন একটি গোষ্ঠীকে তুচ্ছ হিসেবে দেখা হয় ও তাদের ওপর নির্যাতন চালানো শুরু হয় তখন তাদের অসহায়ত্ব কমানো ও অধিকার রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে তাদের বাড়ি-ঘর রক্ষা করার সুযোগ তখনই ধংস করে দেয়া হয়েছে যখন তাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়া হয়েছে। ১৯৭০ সাল থেকে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা নিপীড়ন থেকে বাঁচতে মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
শোচনীয়ভাবে, তারা যেসব দেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে সেসব দেশেও তাদেরকে প্রান্তিক করে রাখা হয়েছে। কোন দেশ তাদের দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক না হওয়ায় তাদেরকে পুনরায় অন্য কোন দেশে চলে যেতে বাধ্য করা হয় অথবা উৎসাহিত করা হয়। আর এই চক্র সম্পন্ন করতে যেই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় তা, রোহিঙ্গাদেরকে এক অসহায় অবস্থায় আটকে রেখেছে।
রোহিঙ্গাদের এই শোচনীয় অবস্থার পেছনে লুকিয়ে আছে আরও অনেক বড় স্বার্থ। যেই স্বার্থ পূরণে মিয়ানমারজুড়ে ও মিয়ানমারের পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছে ও বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন ইস্যুতে ধর্মীয় ও জাতিগত বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা ও জটিলতা অনস্বীকার্য। কিন্তু আমরা এর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট এড়িয়ে যেতে পারিনা। পাশাপাশি এই স্থানচ্যুতির মূল কারণও এড়িয়ে যেতে পারিনা যা প্রায়শই অলক্ষিত থেকে যায়।
(প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথপম প্রকাশিত হয় দ্য কনভার্সন ওয়েবসাইটে ও পরবর্তীতে স্ক্রল ডট ইন ও বার্তা সংস্থা ইউপি আই-তে। প্রতিবেদনটি লিখেছেন, ইউনিভার্সিটি অফ নিউক্যাসলের গিউসেপ্পে ফরিনো- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ওপর পিএইচডি পরীক্ষার্থী; জেসন ভন মেডিং- দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস বিষয়ক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকসাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাস্তুচ্যুত মানুষগুলো নির্যাতন থেকে বাঁচতে আশ্রয়ের খোজে পায়ে হেটে অথবা নৌকায় চড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে।
এই সহিংসতার পেছনে অনেকেই ধর্মীয় ও জাতিগত বৈষম্যকে দায়ী করেছেন। তবে সময় যত গড়াচ্ছে ততই আরও বেশি মনে হচ্ছে যে এর পেছনে আরও কোন কারণ নিহিত রয়েছে। কারণ মিয়ানমারে ১৩৫টি সরকার স্বীকৃত সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে। তবে ১৯৮২ সালে এই তালিকা থেকে রোহিঙ্গাদেরকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়।
সাম্প্রতিক এই সহিংসতা বিশ্লেষণ করার সময়, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো সামরিক বাহিনী ও মিয়ানমারের কার্যত নেত্রী অং সান সুচির দিকেই বেশি নজর দিয়েছে। নতুন করে সহিংসতা শুরুর পর থেকেই শান্তিতে একজন নোবেলজয়ী হিসেবে এই পরিস্থিতি সামলাতে তার ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে বারবার।
এখনও পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ওপর এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিন্দা জানান নি তিনি। ক্লান্ত হয়ে গণমাধ্যমের নজর রোহিঙ্গাদের দুর্দশার দিকে পড়েছে। তবে এখনও এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছেনা। এই নিপীড়নের মূল কারণ হিসেবে শুধু ধর্মীয় ও জাতিগত বৈষম্য ছাড়া আর কোনকিছু দায়ী কি না তা খুজে দেখাটাও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
মিয়ানমার থেকে শুধু রোহিঙ্গা নয়, কাচিন, দ্য শান, দ্য কারেন, দ্য চিন ও দ্য মোনের মতন অন্যান্য গোষ্ঠীর সদস্যরাও বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন। আমাদেরকে অবশ্যই এর পেছনে ব্যাপক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকার বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে।
ভূমি দখল : মিয়ানমারে ব্যাপক পরিমাণে ভূমি দখল ও জব্দ করা হয়। এটা নতুন কিছু নয়। ১৯৯০ সালে থেকেই দেশটির সামরিক জান্তারা ধর্ম- জাত নির্বিশেষে কোন ক্ষতিপূরণ ছাড়াই দেশজুড়ে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জোতদারদের জমি জব্দ করে নিচ্ছে। প্রায়শই বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্যে ভূমি দখল করা হয়ে থাকে।
এসব প্রকল্পের মধ্যে, সামরিক ঘাটির বিস্তার ঘটানো, প্রাকৃতিক সম্পদ নিষ্কাশন ও শোষণ, বড় ধরণের কৃষি প্রকল্প, অবকাঠামো ও পর্যটন প্রকল্পও অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, কাচিন রাজ্যের গ্রামবাসীদের কাছ থেকে ব্যাপক পরিমাণের স্বর্ণ খননের স্বার্থে ৫০০ একর জমি জব্দ করে নিয়েছে সামরিক বাহিনী।
উন্নয়নের স্বার্থে সহস্র মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে- অভ্যন্তরীনভাবে এবং বাংলাদেশ, ভারত ও থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতেও-অথবা তাদেরকে বাধ্য করা হয়েছে সমুদ্রপথে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া চলে যেতে। ২০১১ সালে মিয়ানমার বিদেশি বিনিয়োগ গ্রহণ করা শুরু করে।
দেশটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্করণের ফলে এটি এশিয়ার চূড়ান্ত সীমানা( এশিয়া’স ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার) হিসেবে পরিচিতি পায়। এর কিছু সময় পর, ২০১২ সালে রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়- আর অল্প পরিসরে মুসলিম কারেনদের ওপরেও। এর মাঝে মিয়ানমার সরকার, কৃষিজমির ব্যবস্থাপনা ও বণ্টন সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি আইনও প্রতিষ্ঠা করে।
আইনগুলো বড় বড় কর্পোরেশনগুলোকে জমি দখল করে লাভবান হওয়ার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়ার দায়ে তীব্রভাবে সমালোচিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, কৃষি ব্যবসা বিষয়ক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী ‘পিওএসসিও দায়েও’ সরকারী যোগাযোগের মাধ্যমে আগ্রহ নিয়ে এই মার্কেটে প্রবেশ করে।
একটি আঞ্চলিক পুরস্কার : মিয়ানমার এমন কিছু দেশের মাঝখানে অবস্থান করছে যে দেশগুলো বহুদিন ধরে এর প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আগ্রহ দেখিয়ে আসছে- যেমন চীন ও ভারত। ১৯৯০ সাল থেকে চীনা কোম্পানীগুলো মিয়ানমারের শান রাজ্যের বাশ, নদী ও খনিজ সম্পদ নিয়ে ঘাটাঘাটি করে আসছে।
এ নিয়ে তৎকালীন সামরিক সরকারের সঙ্গে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট অর্গানাইজেশন ও এর জাতিগত মিত্র সংগঠনসহ কাচিন ও শান রাজ্যের অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীগুলোর সহিংসতার সৃষ্টি হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে চীন ও ভারতের আগ্রহ হচ্ছে আরও বিস্তৃত চীন-ভারত সম্পর্কের একটি অংশ। এই আগ্রহ মূলত মিয়ানমারজুড়ে বিভিন্ন অবকাঠামো ও পাইপলাইন নির্মানের চারপাশেই ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে।
এই ধরণের প্রকল্পগুলো পুরো মিয়ানমারের জন্যে চাকরী, পরিবহণ ফি, তেল ও গ্যাস রাজস্ব নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। এরকম বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের মধ্যে, ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাখাইন প্রদেশের রাজধানী সিত্তুয়ি শহর থেকে চীনের কানমিং শহর পর্যন্ত একটি বহুজাতিক পাইপলাইন নির্মানের কাজ শুরু করে চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন।
মিয়ানমার থেকে চীনের গুয়াংঝো শহরে অবস্থিত শুই গ্যাসক্ষেত্রে তেল ও গ্যাস নেওয়ার ব্যাপক চেষ্টার কথা বেশ ভালোভাবেই নত্থিভুক্ত আছে। এছাড়া মিয়ানমারের কিয়ায়ুখফিয়ু বন্দর থেকে একটি সমান্তরাল পাইপলাইন চীনে মধ্য-প্রাচ্যীয় তেল সরবরাহ করার সম্ভাবনাও রয়েছে।
তবে, দ্য এডভাইজোরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট মিয়ানমার সরকারকে এর প্রভাব সুষ্ঠুভাবে বিবেচনা করার আহবান জানিয়েছে। এমনকি এই নিরপেক্ষ কমিশনটি এটাও বলেছে যে, এই পাইপলাইন স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোকে ঝুকির মধ্যে ফেলবে। স্থানীয়দের মধ্যে জমি বাজেয়াপ্তকরণ, অপর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ, পরিবেশগত অবনতি ও স্থানীয়দের কাজ করার সুযোগ দেয়ার বদলে বিদেশী কর্মী নিয়োগ দেয়ার মতো বিষয় নিয়ে ভয় কাজ করছে।
এদিকে কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্টেশোন প্রকল্পের অংশ হিসেবে সিত্তুয়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মান ও অর্থায়ন করেছে ভারত। উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের সংযোগ ঘটানো। রাখাইন রাজ্যের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো পরিষ্কারভাবেই চীন ও ভারত উভয়ের কাছেই কৌশলগত কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
আর মিয়ানমার সরকার তাই ভবিষ্যত উন্নয়ন ও দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গতি বৃদ্ধির খাতিরে অঞ্চলটির ভূমি পরিষ্কার করার দিকে দেখাচ্ছেন। এর সবকিছুই ভূ-রাজনৈতিক চাল চালার এক বৃহত্তর প্রেক্ষাপটের ভেতরে ঘটছে। এসবের মাঝে জাতিগত উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়ায় বাংলাদেশের ভূমিকাও বেশ আপত্তিকর। ক্ষমতার এরকম সংগ্রামে, মানবিক ক্ষতি অপূরণীয়।
সংখ্যালঘুদের দুর্বলতা জোরদার করা : মিয়ানমারে যে গোষ্ঠীগুলো জমি দখলের খপ্পরে পড়েছে সেগুলোর বেশিরভাগের শুরুই চরম পর্যায়ের অসহায়ত্ব দিয়ে হয়েছে। আর শেষ হয়েছে আরও খারাপ পরিস্থিতি দিয়ে। মিয়ানমারে সংখ্যালঘুদের ওপর যে ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নির্যাতন।
যখন একটি গোষ্ঠীকে তুচ্ছ হিসেবে দেখা হয় ও তাদের ওপর নির্যাতন চালানো শুরু হয় তখন তাদের অসহায়ত্ব কমানো ও অধিকার রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে তাদের বাড়ি-ঘর রক্ষা করার সুযোগ তখনই ধংস করে দেয়া হয়েছে যখন তাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়া হয়েছে। ১৯৭০ সাল থেকে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা নিপীড়ন থেকে বাঁচতে মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
শোচনীয়ভাবে, তারা যেসব দেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে সেসব দেশেও তাদেরকে প্রান্তিক করে রাখা হয়েছে। কোন দেশ তাদের দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক না হওয়ায় তাদেরকে পুনরায় অন্য কোন দেশে চলে যেতে বাধ্য করা হয় অথবা উৎসাহিত করা হয়। আর এই চক্র সম্পন্ন করতে যেই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় তা, রোহিঙ্গাদেরকে এক অসহায় অবস্থায় আটকে রেখেছে।
রোহিঙ্গাদের এই শোচনীয় অবস্থার পেছনে লুকিয়ে আছে আরও অনেক বড় স্বার্থ। যেই স্বার্থ পূরণে মিয়ানমারজুড়ে ও মিয়ানমারের পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছে ও বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন ইস্যুতে ধর্মীয় ও জাতিগত বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা ও জটিলতা অনস্বীকার্য। কিন্তু আমরা এর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট এড়িয়ে যেতে পারিনা। পাশাপাশি এই স্থানচ্যুতির মূল কারণও এড়িয়ে যেতে পারিনা যা প্রায়শই অলক্ষিত থেকে যায়।
(প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথপম প্রকাশিত হয় দ্য কনভার্সন ওয়েবসাইটে ও পরবর্তীতে স্ক্রল ডট ইন ও বার্তা সংস্থা ইউপি আই-তে। প্রতিবেদনটি লিখেছেন, ইউনিভার্সিটি অফ নিউক্যাসলের গিউসেপ্পে ফরিনো- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ওপর পিএইচডি পরীক্ষার্থী; জেসন ভন মেডিং- দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস বিষয়ক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ও থমাস জনসন- দুর্যোগ ঝুঁকির ওপর পিএইচডি পরীক্ষার্থী। প্রতিবেদনটির অনুবাদ করেছেন রিফাত আহমাদ।) ও থমাস জনসন- দুর্যোগ ঝুঁকির ওপর পিএইচডি পরীক্ষার্থী। প্রতিবেদনটির অনুবাদ করেছেন রিফাত আহমাদ।)
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন