সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে মৃত্যুর পথ বেছে নিলেন মা!

মার্চ মাসের দিকে মাথাব্যথা শুরু হয়। বমি শুরু না হওয়ার আগ পর্যন্ত মাইগ্রেনের সমস্যা হয়েছে, এটাই মনে করা হচ্ছিল। এরপর দ্রুত ক্যারি ডেকলিনের মস্তিষ্ক একটি স্ক্যান করা হয়। আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় ক্যানসার ধরা পড়ে। সম্ভবত লিম্ফোমা। তবে নিরাময়যোগ্য। প্যাথোলজি পরীক্ষায় আরো ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ওয়াইওমিং শহরের ৩৭ বছর বয়সী এই মা গ্লিওব্লাসটোমা আক্রান্ত (মস্তিষ্কের ক্যানসারের অগ্রর্বতী পর্যায়)। তবে ভাগ্য ভালো, তিনি আরো পাঁচ বছর বাঁচতে পারবেন।

তাঁর স্বামী নিক ডেকলিন বলেন, ‘এপ্রিলে সার্জারি করে টিউমার বের করা হয়’। তবে এক মাস যেতে না যেতেই এই দম্পতি দুটি ভয়াবহ সংবাদ পান : টিউমার আবার হয়েছে এবং ক্যারি আট সপ্তাহের সন্তানসম্ভবা। তবে নিজের মৃত্যুর পথ বেছে নিয়ে শেষ পর্যন্ত সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানোর সীদ্ধান্ত নেন এই মা। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যম এমএসএনে প্রকাশিত হয়েছে এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা।

সন্তানসম্ভবা হওয়ার সংবাদ পাওয়ার পর এই দম্পতির কাছে মাত্র দুটো পথ খোলা ছিল। ক্যারির জীবনকে বাঁচানো, কেমোথেরাপির মাধ্যমে। তবে এ জন্য গর্ভের সন্তানটিকে বাঁচানো যাবে না। আর আরেকটি হলো শিশুটিকে হয়তো পৃথিবীর আলো দেখানো সম্ভব, তবে ক্যারি হয়তো শিশুটিকে দেখার জন্য আর বেঁচে থাকবেন না।

সীদ্ধান্ত নেওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল। তবে এগুলোই সমাধান। দ্বিতীয় সার্জারির করে টিউমার বের করার পর এই দম্পতি বাড়ি ফিরলেন। এ সময় ক্যারির আর ৩৪ সপ্তাহ বাকি। তাঁর স্ত্রী চেয়েছিলেন শিশুটি পৃথিবীর আলো দেখুক।

নিক বলেন, ‘আমি ঈশ্বরকে ভালোবাসি। আমরা বিশ্বাস করি ঈশ্বর আমাদের শিশুটিকে দিয়েছেন’।

‘জুনের শেষে টিউমার পুনরায় হয়। তবে এটি তখন অস্ত্রোপচারের মতো অবস্থায় ছিল না। চিকিৎসক তখন বলেছিলেন, তারা কেবল ব্যথা কমানোর জন্য মস্তিষ্কে তরল গ্রহণের এক ধরনের চিকিৎসা করতে পারেন’, বলেন নিক।

নিক বলেন, ‘জুলাইয়ের মাঝামাঝি ক্যারিকে এন এরবোরে ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান হসপিটালে নিয়ে আসা হয়। ক্যারি ব্যথায় চিৎকার করছিল এবং তার খিঁচুনি হচ্ছিল। এটা ছিল তার সচেতন থাকার শেষ সময়। চিকিৎসকরা জানান, সে বড় ধরনের স্ট্রোক করেছে’। তখন ক্যারি ১৯ সপ্তাহের সন্তানসম্ভবা ছিলেন। ডাক্তার তাকে বলেন, সন্তানকে ক্রমশ বাড়ানোর জন্য তারা কী করতে পারে। তবে ক্যারি হয়তো আর উঠবে না। এটি করলে সে তার পরিবারকে চিনতে পারবে না। স্ট্রোকের কারণে তার মস্তিষ্কের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর কারণে তাকে ভুগতে হবে। পরের কিছু সপ্তাহ শিশু ও মাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ফিডিং টিউব ও ব্রেদিং মেশিন লাগানো হয়।

‘দুই সপ্তাহ পর আরেকবার স্ট্রোক হয়। ডাক্তার মস্তিষ্কের খুলি অপসারণ করেন’, নিক বলেন। তিনি বলেন, ‘তার শিশুটি ভালোভাবে বড় হচ্ছিল না। ওজন ছিল মাত্র ৩৭৮ গ্রাম অথবা আট দশমাংশ পাউন্ড। বাঁচার জন্য শিশুটিকে অন্তত ৫০০ গ্রাম বা তার বেশি হওয়া প্রয়োজন’।

এরপর আরো কিছুদিন পার হলো। ভালো খবর এলো, শিশুটির ওজন ৬২৫ গ্রাম হয়েছে। তবে খারাপ খবর ছিল শিশুটি নড়াচড়া করছে না।

নিক জানান, তাঁদের কাছে তখন দুটো পথ খোলা। কিছু না করা, কেবল আশা করা যে শিশুটি নড়াচড়া শুরু করুক এবং বৃদ্ধি চালানো। তবে কিছু না করার মানে হলো শিশুটি এক ঘণ্টার মধ্যে মারা যাবে। অথবা সিজারিয়ান সেকশন করা যেতে পারে।

নিক সিজারিয়ান সেকশনের সীদ্ধান্ত নিলেন। তাঁর মেয়ে লাইফ লিন ডেকলিন জন্ম নিল বিকেল ৫টা ৩০ মিনিটে। দিনটি ছিল বুধবার। তার ওজন ছিল এক পাউন্ড চার আউন্স। নিক জানান, তাঁর স্ত্রী অসুস্থ হওয়ার আগেই শিশুটির নামকরণ করা হয়েছিল।

তিনি বলেন, ‘এটি এক ধরনের তিক্ত-মিষ্টি অনুভূতি। কারণ,আমার স্ত্রী আর জাগেনি। সে আর নেই। এরপর আমি সার্জনের কাছে গেলাম। আমার স্ত্রী শেষ পাঁচ মাস খুব কষ্ট পেয়ে গেলেন। চিকিৎসকর তাঁর অবস্থা খারাপ বলার পরও সে অনেকটা সময় বেঁচে ছিলেন।’

‘আমি তার হাতে হাত রেখে পুরো সময় বসেছিলাম। আমি তাকে চুমু দেই। বলি সে অনেক ভালো ছিল’- নিক বলেন।‘ আমি তাকে বলি, আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং আমি তোমাকে স্বর্গে দেখতে পাব।’

শুক্রবার সকালে,ক্যারি একবার তার চোখ খুলেন। আবার বন্ধ করে ফেলেন। তিনি তার হাতকে শক্ত করে মুঠো করেন,আবার ছেড়ে দেন। তিনি শ্বাস নেওয়া বন্ধ করেন। ক্যারি ভোর ৪টা ৩০ মিনিটে মারা যান।

ক্যারির এই গল্পের ধারা বিবরণী দেওয়া হয়েছে একটি ফেসবুক পেজে। নাম কিউর ফোর ক্যারি। পেজটির ফলোআর ১৬ হাজার।

শিশুর জন্মের চারদিন পর এবং স্ত্রীর মৃত্যুর দুদিন পর নিক একটি অন্তেষ্টিক্রিয়া করেন এবং তার নবজাতকের পরিচর্যার জন্য তার সময় ভাগ করেন। কয়েক সপ্তাহ শিশুটিকে নিবিড় পরিচর্যায় থাকতে হয়।

৩৯ বছর বয়সী নিক এখন তাঁর পরিবারের ভবিষতের কথা ভাবছেন। তিনি জানান, চার বছর আগে তিনি একটি ভেন্ডিং মেশিন কোম্পানি শুরু করেন। তবে পরে এটি তিনি তার ভাইয়ের কাছে বিক্রি করে দেন। এখন তার আয়ের কোনো উৎস নেই। ‘আমার স্ত্রী চলে গেছেন। আমার ছয় সন্তান। আমি এখন আমার ছোট মেয়েটির দিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি, তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্য।’

যারা এই দম্পতির সিদ্ধান্ত এবং ক্যারির নিঃস্বার্থ সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল তাদের কথাকে নাকচ করেন নিক। নিক বলেন, ‘আমার স্ত্রী সন্তানের জন্য তার জীবন দিল। আমি মানুষকে জানাতে চাই আমার স্ত্রী প্রভুকে ভালোবাসত। সে তার সন্তানকে ভালোবাসত। সে আমার মেয়েকে নিজের ওপরে রাখল।’