হারিয়েছি যাদের : বৈমানিক রোকসানা থেকে পৃথুলা
রীনা আকতার তুলি : বিমান দুর্ঘটনায় না ফেরার দেশে চলে গেছেন চার নারী বৈমানিক (১৯৮৪-২০১৮)। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রথম নারী বৈমানিক সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রোকসানা ১৯৮৪ সালের ৪ আগস্ট, ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর এয়ার পারাবাতের সেসনা-১৫০ প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় প্রশিক্ষক বৈমানিক ফারিয়া লারা, রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দরে ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমির প্রশিক্ষণ বিমান সেচনা-১৫২ দুর্ঘটনায় প্রশিক্ষণার্থী বৈমানিক তামান্না রহমান হৃদি ও ১২ মার্চ নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বিমান দুর্ঘটনায় না ফেরার দেশে চলে গেলেন বৈমানিক পৃথুলা রশীদ।
জলাভূমিতে বিধ্বস্ত হয়ে নিহত বৈমানিক কানিজ ফাতেমা রোকসানা
বাংলাদেশের সরকারি বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রথম নারী বৈমানিক সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রোকসানা। তিনি বাণিজ্যিক বিমান পরিচালনার সনদ লাভ করেন ১৯৭৭ সালে। এরপর সাত বছর তিনি দক্ষতার সঙ্গে বিমান চালান। সময়টি ছিল ১৯৮৪ সালের ৪ আগস্ট। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে ফকার এফ-২৭ বিমান চালাচ্ছিলেন তিনি। বিমানে ৪৫ জন যাত্রীসহ ৪ জন ক্রু ছিলেন। ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের সময় বৃষ্টিবিঘ্ন আবহাওয়ার কারণে তার বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়। ঘটনাস্থলে তিনিসহ সবাই নিহত হন। নিহতদের মধ্যে একজন ব্রিটিশ নাগরিক, একজন জাপানি ও ৩৩ জন মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত বাংলাদেশি ছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আগত অভ্যন্তরীণ এ ফ্লাইটটি অত্যধিক বৃষ্টিপাতের কারণে দু’বার অবতরণের চেষ্টা করেও রানওয়ে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়। তৃতীয়বার অবতরণের চেষ্টা করতেই বিমানটি রানওয়ে থেকে ৫০০ মিটার আগের এক জলাভূমিতে পতিত হয়ে বিধ্বস্ত হয়।
কয়েক মিনিট বেঁচে আছি পৃথিবীতে বৈমানিক ফারিয়া লারা
‘আমি আর কয়েক মিনিট বেঁচে আছি পৃথিবীতে। আমি হয়তো আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছি।’ বিমানটি দুর্ঘটনায় পড়ার কিছুক্ষণ আগে প্রশিক্ষক বৈমানিক ফারিয়া লারা বিমান থেকে পাঠানো জরুরি বার্তা ‘মে ডে কল’ এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ কক্ষকে জানিয়েছিলেন।
বৈমানিক ফারিয়া লারা বিমান চালনায় বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রশিক্ষক। তিনি ছিলেন তীক্ষèধীসম্পন্ন, সাহসী, স্বপরিচয়ে সচেষ্ট। শৈশব থেকে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছবি আঁকা, অভিনয়, গল্পবলা, আবৃত্তি আর বিতর্কে লারা প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। অর্জন করেছেন প্রশংসা ও নানা পুরস্কার। এসব পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে- ছবি এঁকে ১৯৭৮ সালে কোরিয়ান চিলড্রেন সেন্টার পুরস্কার, ১৯৭৯ সালে ফিলিপস বাংলাদেশ পুরস্কার, ১৯৮০ সালে নিপ্পন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আয়োজিত প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক, ১৯৮৪ সালে ভারতের শংকর আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এ ছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশন আয়োজিত জাতীয় পর্যায়ে ‘নতুন কুঁড়ি’ প্রতিযোগিতায় ১৯৭৮ সালে ছবি আঁকা ও উপস্থিত বক্তৃতায় পুরস্কার লাভ করেন।
লারা ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী ছাত্রী। ‘সাপ্তাহিক সময়’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গবেষণা, অনুবাদ, দোভাষীর কাজ করেছেন। অধ্যাপনা, গবেষণা কিংবা প্রথাগত কোনো চাকরি না করে বৈমানিকের দুঃসাহসী পেশা বেছে নিয়েছিলেন। ফারিয়া লারা সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ কর্তৃক প্রাইভেট পাইলট’স লাইসেন্স অর্জন করেন ১৯৯৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। বাণিজ্যিক লাইসেন্স অর্জন করেন ১৯৯৮ সালের ১৯ মার্চ। প্রশিক্ষক হওয়ার জন্য ফারিয়া লারার প্রয়োজনীয় ফ্লাইং সমাপ্ত করার প্রায় তিন মিনিট বাকি ছিল। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি এয়ার পারাবাতের সেসনা-১৫০ প্রশিক্ষণ বিমান চালাচ্ছিলেন। যান্ত্রিক ত্র“টির কারণে সকাল ১০টা ২৩ মিনিটে ঢাকার পোস্তগোলায় তার বিমানটি বিধ্বস্ত হলে তিনি নিহত হন।
ককপিটের ভেতরে আগুনে পুড়ে নিহত বৈমানিক তামান্না রহমান হৃদি
তামান্না রহমান হৃদি প্রশিক্ষণার্থী বৈমানিক ছিলেন। প্রথম একক ফ্লাইট উড্ডয়নের কৃতিত্ব উদযাপনের আগেই রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দরে ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল বেলা ১টা ৫৮ মিনিটে বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমির প্রশিক্ষণ বিমান সেচনা-১৫২ দুর্ঘটনায় নিহত হন। যান্ত্রিক ক্রুটির কারণে উড্ডয়নের পরপরই ইঞ্জিনে আগুন ধরে যাওয়ায় প্রশিক্ষক বৈমানিক সাইদ কামাল রানওয়েতে নামার জন্য গ্রাউন্ডে সিগনাল পাঠান। তিনি রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দরে অবতরণের চেষ্টা করেন। তার সঙ্গে ছিলেন প্রশিক্ষণার্থী বৈমানিক তামান্না রহমান হৃদি। প্রশিক্ষক বৈমানিক সাইদ কামাল বের হতে পারলেও তামান্না ককপিটের ভেতরে আটকা পড়ে আগুনে পুড়ে নিহত হন।
পৃথুলা রশীদের স্বপ্ন পুড়ে ছাই হল কাঠমাণ্ডুতে
পৃথুলা রশীদের ঘরে ঢুকতেই বাম দেয়ালে আটকানো বিশাল আকৃতির পোস্টার। পোস্টারের একেবারে উপরে বাঁয়ে লেখা ফ্লাইট সেফটি বোম্বার্বাডিয়ার কিউ ফোর জিরো জিরো। তার পাশে বিমানের ককপিট প্যানেলের ছবি। বাবা-মা আদর করে মেয়ের নাম রেখেছিলেন ‘পৃথুলা’। খোলা আকাশে ডানা মেলে পাখির মতো ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে ছিল তার শৈশব থেকেই।
শৈশবের সেই স্বপ্ন পূরণে তাদের আদরের পৃথুলা বড় হয়ে পাইলট হয়েছিলেন। একমাত্র সন্তান হওয়ায় মেয়ের ইচ্ছে অপূর্ণ রাখেননি বাবা আনিসুর রশিদ ও মা রাফেজা বেগম। মেয়ের স্বপ্ন পূরণে বাবা-মা সবসময় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।
কিন্তু ১২ মার্চ নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ায় সেই স্বপ্ন চিরদিনের মতো নিভে যায়। প্রিয়জনদের ছেড়ে চলে যান পৃথুলা না ফেরার দেশে। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে শোকতপ্ত মা আঁকড়ে রয়েছেন মেয়ের পোশাক, খেলার পুতুল, বই-খাতা। শুধু বিলাপ করছেন। জীবন যেন থেমে গেছে তাদেরও। গোসল নেই, খাওয়া নেই, ঘুম নেই। ডায়াবেটিস আর থাইরয়েড ক্যান্সার আক্রান্ত রাফেজা বেগম ওষুধ খেতে ভুলে গেছেন। শোকসন্তপ্ত রাফেজা বেগমকে কীভাবে সান্ত্বনা দেবেন স্বজনরা? সে ভাষাও তাদের জানা নেই।
জ্ঞান ফিরতেই বিলাপ করতে করতে রাফেজা বেগম আপন মনে বলে ওঠেন, মা তোমাকে স্যালুট। অন্যদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছ, আমি গর্বিত। আল্লাহ তোমায় জান্নাতবাসী করুক। কথা বলতে বলতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন পৃথুলার মা। চোখেমুখে পানির ঝাঁপটা দিতেই চোখ মেলে তাকান তিনি। চোখের পানি বাঁধ মানে না তার।
আবার বলতে শুরু করেন, অনেক কষ্টে মেয়েকে বড় করেছি। ওর ইচ্ছে ছিল বিমান চালিয়ে আমাদের নিয়ে পৃথিবী ঘুরে বেড়াবে। ওর সেই স্বপ্ন পূরণ হল না। এর আগেই হারিয়ে গেল জীবন থেকে।
চোখ বুজলেই পৃথুলার মুখটা ভেসে ওঠে। ওর মা ডাক আমার কানে বাজে। পৃথুলা ছাড়া আমার ঘর যে শূন্য। পৃথুলার বাবা আনিসুর রশীদ ২১ বছর রাশিয়ায় ছিলেন। বাংলাদেশের সিভিল এভিয়েশন অথরিটির ভেতরে স্থাপিত অরিয়াম ফ্লাইট একাডেমি থেকে পাইলটের কোর্স সম্পন্ন করেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন