৭৫,০০০ রহস্যের সমাধান করেছেন যেই নারী!

গোয়েন্দা শব্দটা উচ্চারণ করলে মাথার মধ্যে কোন ইমেজ ফুটে ওঠে আপনার? ধুতি পরা ব্যোমকেশ? নাকি জিনস আর পাঞ্জাবি পরা ফেলুদা? সাহেব সাজা কিরীটীও আসতে পারেন কল্পনায়। কিন্তু কিছুতেই শাড়ি পরা এক মধ্যবয়সিনীকে কল্পনা করতে সহজে মন চাইবে না আপনার।

অথচ আপনি পড়েছেন আগাথা ক্রিস্টির ভুবনজয়ী নারী-গোয়েন্দা মিস মার্পলের কাহিনি, দেখেছেন আ পকেটফুল অফ রাই-এর বিবিসি-চিত্রায়ন (১৯৮৫)। অথবা মনে পড়তেই পারে, ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি শুভ মহরৎ (২০০৩), যখানে এক নিতান্ত বাঙালি বিধবা মহিলার গোয়েন্দাগিরিতে উঠে আসে এক জটিল হত্যা মামলার সমাধান-সূত্র।

গোয়েন্দাগিরিতে মেয়েদের আনফিট মনে করার কোনও কারণ নেই, এ কথা স্বীকার করে নিতে কসুর নেই আমাদের। কিন্তু যদি উদাহরণ দিতে বলা হয়, তখন সাহিত্য আর সিনেমা থেকে চরিত্র তুলে আনা ছাড়া উপায় থাকে না। আমাদের দেশে প্রাইভেট ডিটেকটিভ ব্যাপারটাও কেমন একটা ধোঁয়াটে পেশা। তার উপরে সেই পেশায় মহিলা খুঁজে পাওয়া তো আরও দুরূহ। কিন্তু এই বিরল বাজারে একজন অন্তত রয়েছেন, যিনি যাবতীয় সামাজিক বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে রীতিমতো গোয়েন্দাগিরি করে চলেছেন প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে। রজনী পণ্ডিতের জন্ম মহারাষ্ট্রের থানে জেলার পালঘর নামের এক মফস্‌সল শহরে। তাঁর বাবা শান্তারাম পণ্ডিত মুম্বই পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেটর ছিলেন।

মুম্বইয়ের রুপারেল কলেজে মারাঠি সাহিত্য নিয়ে স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করার সময়েই রজনী আগ্রহী হয়ে পড়েন গোয়েন্দাগিরিতে। সত্যি বলতে, কলেজে পড়ার সময়েই তাঁর প্রথম ‘কেস’টি সমাধা করেন রজনী। ক্লাসের মধ্যেই এক রহস্যের গন্ধ পান রজনী। তিনি লক্ষ করেন তাঁর এক সহপাঠিনী অদ্ভুত আচরণ করছে। সে তার বাবা-মাকে ক্রমাগত মিথ্যে কথা বলছে এবং মাঝে মাঝেই কিছুক্ষণের জন্য উধাও হয়ে যাচ্ছে। রজনী মেয়েটিকে অনুসরণ করা শুরু করেন। এবং আবিষ্কার করেন, মেয়েটি কুসঙ্গে পড়েছে। তিনি মেয়েটির বাবা-মাকে বিষয়টি জানান। কিন্তু তাঁরা প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাননি ব্যাপারটা। তখন তিনি লুকিয়ে মেয়েটির কিছু ছবি তোলেন এবং সেগুলি তার বাবা-মাকে দেখালে তাঁরা বুঝতে পারেন, কী ঘটে চলেছে। তাঁরা রজনীকে স্পাই বলে সম্বোধন করেছিলেন সেই সময়ে। শব্দটায় খানিক অবজ্ঞা ছিল নিশ্চিত। কিন্তু সোজা-সাপটা মেয়ে রজনী সেই সময়ে শব্দটার মানে ঠিকমতো জানতেন না।

ক্রমশ তাঁর এই ‘স্পাই-গিরির খবর ছড়াতে শুরু করে। দুই আর দুই-এ পাঁচ হলে কোথায় গোঁজামিল দেওয়া হয়েছে, সেই যুক্তিসূত্রকে খুঁজে বের করার কাজে ক্রমেই দক্ষ হয়ে উঠতে থাকেন রজনী। ক্রমে প্রতিবেশীদের মধ্যে থেকেও আসতে তাকে কেস। এক মহিলা রজনীর কাছে আসেন, তাঁর স্বামীর অস্বাভাবিকতার কারণ বের করে দেওয়ার বরাত নিয়ে। সেই ভদ্রলোক ভালই আয় করতেন। কিন্তু বাড়িতে প্রায় কিছুই এসে পৌঁছত না। রজনী অনুসন্ধান করে জানতে পারেন, ভদ্রলোক মদের পিছনেই সব টাকা খরচ করে ফেলছেন। আর বাড়িতে জানাচ্ছেন, টাকা পকেটমার হয়ে গিয়েছে। সাফল্য একদিনে আসেনি। রজনী বুঝতে পারেন, এই অনুসন্ধানবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নেওয়াই যায়। এর জন্য কোনও আলাদা ডিগ্রি-ডিপ্লোমার প্রয়োজন নেই। আর এই বিন্দু থেকেই জন্ম হয় ‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ’ রজনী পণ্ডিতের।

৫১ বছর বয়সের রজনী অসংখ্য কেসে সফল। এর মধ্যে অনেকগুলিতেই প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা ছিল। এমন অপরাধীকেও তিনি ধরেছেন, যার অপরাধের প্রমাণ পাওয়াই দুরূহ ছিল। এক কেস থেকে আর এক কেস-এ গড়িয়ে গিয়েছে রজনীর গোয়েন্দাগিরি। প্রায়শই ছদ্মবেশ ধরতে হয় তাঁকে। কখনও কাজের লোক, কখনও উন্মাদিনী সেজে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারেন রজনী। প্রায় ৭৫,০০০ কেস তিনি সমাধা করেছেন। পুরস্কার পেয়েছেন ৫৭টি। আজ তাঁর নিজের অফিস রজনী ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো-তে ২০ জনের একটি দল কাজ করে। শুধুমাত্র টাকা নয়, এই পেশার প্রতি প্রেম আর প্যাশনই তাঁকে চালিত করে— জানাতে দ্বিধাবোধ করেন না ভারতের সম্ভবত একমাত্র মহিলা গোয়েন্দা রজনী পণ্ডিত।