এত তর্ক করছেন কেন? খালেদা জিয়ার আইনজীবীকে বিচারক

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, আগে এখানে (খালেদা জিয়ার বসার জন্য নির্ধারিত স্থান) দেয়াল ছিল না। আমি কিছুই (বিচারককে) দেখতে পারছি না। যদি এভাবে আমাকে অপমানজনকই রাখতে হয়, তাহলে ডকে (আসামিদের রাখার জন্য নির্ধারিত স্থান) নিয়ে রাখুন।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতে গ্যাটকো দুর্নীতি মামলার শুনানিকালে তিনি এসব কথা বলেন।

এদিন চার্জ (অভিযোগ) গঠন সংক্রান্ত শুনানিতে উপস্থিত না থাকায় সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেন ও প্রয়াত মন্ত্রী কর্নেল আকবর হোসেনের ছেলে ইসমাইল হোসেন সায়মনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। একইসঙ্গে পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন। ঢাকার তিন নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন এ আদেশ দেন।

এদিন দুপুর ১২টা ৩৯ মিনিটের দিকে কারাগার থেকে খালেদা জিয়াকে আদালতে আনা হয়। হুইলচেয়ারে আসা খালেদা জিয়া এ সময় হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পরা ছিলেন। এদিন তাকে আদালতের ডকে না রেখে তার জন্য অল্প উঁচু করে দেয়াল তৈরি করে বিচারকের পাশেই পৃথক এক স্থানে রাখা হয়।

কিছুক্ষণ পরই এজলাসে বিচারক প্রবেশ করলে বিচারকাজ শুরু হয়।

শুরুতেই আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. মাসুস আহমেদ তালুকদার আদালতের উদ্দেশে বলেন, উনাকে (খালেদা জিয়া) যেখানে বসানো হয়েছে, সেখান থেকে আপনাকে (বিচারক) দেখা যায় না। প্রয়োজনে তাকে (খালেদা জিয়াকে) জিজ্ঞাসা করুন।

তখন খালেদা জিয়া বলেন, আমি আপনাকে (বিচারক) দেখতে পারছি না। বিচারক আসামিপক্ষের আইনজীবীদের এ বিষয়টি নিয়ে এত কথা না বাড়িয়ে শুনানি চালিয়ে যেতে বলেন।

এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, উনাকে (খালেদা জিয়া) সামনে নিয়ে আসুন। বিচারককে দেখাতে পারা আসামির অধিকার।

বিচারক বলেন, আজ (বৃহস্পতিবার) বসুন, পরবর্তী করা হবে। তাতেও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা মানতে নারাজ হলে বিচারক তাদের উদ্দেশে বলেন, আজকের কার্যক্রম শেষ হোক। আগামীতে করা হবে। এ নিয়ে এত তর্ক করছেন কেন?

প্রত্যুত্তরে মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, আমরা তর্ক করছি না। আমরা আপনাকে সহযোগিতা করতে চাই। কিন্তু ডিজগাস্টিং (বিরক্তিকর) উপায় করলে আমরা কীভাবে আপনাকে সহযোগিতা করব তা ভাবতে হবে।

এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, এভাবেই সঠিক আছে। এটা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। এ সময় খালেদা জিয়া বলেন, এটা (বসার স্থান) এভাবে (দেয়াল করে পৃথক করা) ছিল না। আর এত পুলিশ আমাকে ঘিরে রেখেছে কেন? আমি কিছুই দেখাতে পারছি না। যদি এভাবে অপমানজনকই রাখতে হয়, তাহলে ডকে নিয়ে রাখুন। তখন বিচারক পুলিশদের সরে যেতে নির্দেশ দেন এবং পরবর্তী সময়ে বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বাস দেন।

এ সময় আসামিপক্ষের অপর আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, উনাকে (খালেদা জিয়া) পেশকারের পেছনে রাখা হয়েছে। এটা নিন্দনীয় ও অপমানজনক। এরপর বিচারক শুনানি শুরু করার নির্দেশ দেন।

দুপুর ১২টা ৫২ মিনিটের দিকে আসামি সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী পক্ষে আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম মিয়া বলেন, আমরা আদালতে আবেদন করেছিলাম। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের শুধুমাত্র মামলার এফআইআর, চার্জশিট ও ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারার স্টেটমেন্ট দেয়া হয়েছে। চার্জশিটে যেসব আলামতের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো দেয়া হয়নি। আমাদের সব ডকুমেন্ট দেখাতে হবে। তাহলে আমরা চার্জ শুনানির করতে পারব। চার্জশিটের আলামত কলামের ডকুমেন্টগুলো আমরা চাই। এরপর অপর আসামিদের পক্ষেও প্রায় একই আবেদন করে ওই ডকুমেন্টগুলা চাওয়া হয়। আদালত আসামিপক্ষের চার্জ শুনানি পরে শুনবেন বলে প্রসিকিউশনকে চার্জ শুনানি শুরু করতে নির্দেশ দেন। মোশাররফ হোসেন কাজল শুরু করতে চাইলেও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বাধার কারণে তা আর হয়নি।

শুনানির একপর্যায়ে এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, উনাকে (খালেদা জিয়া) আইস্যলুটেট করে রাখছেন কেন? এক জায়গায় এভাবে পৃথক করে। প্রত্যুত্তরে মোশাররফ হোসেন কাজল আদালতের উদ্দেশে বলেন, সব আসামিকে ডকে রাখার আদেশ দেন। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। দুপুর ১টা ৩০ মিনিটের দিকে আদালত সব আসামিকে ডকে যাওয়ার আদেশ দেন।

এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ফের সময় শুনানি করেন। আদালত আসামিপক্ষের সময় আবেদন মঞ্জুর করে পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন। একই সঙ্গে অনুপস্থিত দুজন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।

দুপুর ১টা ৩৪ মিনিটের দিকে আদালতের কার্যক্রম শেষ হয়। আদালতের কার্যক্রম শেষে খালেদা জিয়া তার আইনজীবীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন। এরপর খালেদা জিয়াকে গাড়িতে করে ফের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

আদালত সূত্র জানায়, দুদকের দেয়া চার্জশিটের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে মামলা বাতিল চেয়ে রিট আবেদন করেছিলেন খালেদা জিয়া। রিট আবেদনের কারণে প্রায় ৮ বছর নিম্ন আদালতে বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। রিট খারিজ করে উচ্চ আদালত ২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে দুই মাসের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশে ওই বছরের বছর ৫ এপ্রিল আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন খালেদা জিয়া।

২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও থানায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে এ মামলাটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের উপপরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের কাজ গ্লোবাল অ্যাগ্রো ট্রেড কোম্পানিকে (গ্যাটকো) পাইয়ে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রের প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।

২০০৮ সালের ১৩ মে তদন্ত শেষে দুদকের উপপরিচালক জহিরুল হুদা খালেদা জিয়াসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। বর্তমানে এ মামলায় আসামির সংখ্যা ১৭ জন। বাকি ৭ আসামি মারা গেছেন।