উচ্চ আদালতে এখনো ইংরেজির আধিক্য, ফেব্রুয়ারি আসলে বাংলায় রায়ের আলোচনা

সংবিধান এবং আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে অধস্তন আদালতে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব রায়ই বাংলায় দেন বিচারকেরা। আইনজীবীরা আবেদনও জমা দেন প্রায় সব বাংলায়। তবে ব্যতিক্রম উচ্চ আদালতের ক্ষেত্রে। সুপ্রিম কোর্টে কয়েকজন বিচারপতি বাংলায় রায় দিলেও বাকিরা দেন ইংরেজিতে। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া সব আবেদনও জমা দেয়া হয় ইংরেজিতে। যদিও উচ্চ আদালতে আগের চেয়ে বাংলায় রায় দেওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।

অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, মাতৃভাষায় রায় দেওয়ার ঘটনা অনেক আগেই সুপ্রিম কোর্ট শুরু হয়েছে। বিচারপতিরা চেষ্টা করছেন যত বেশি রায় বাংলায় দেয়া যায়। আর অ্যাপসের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে সব রায়ই বাংলায় হবে।

সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সংবিধানের এই বিধান সঠিকভাবে পালন না হওয়ায় ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন করা হয়। আইনের ৩ (১) ধারায় বলা হয়েছে, এই আইন প্রবর্তনের পর দেশের সর্বত্র, তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া অন্যান্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মুন্সী মো. মশিয়ার রহমান বলেন, বাংলা ভাষা প্রচলন আইন সুপ্রিম কোর্টের জন্য অ্যাপ্লিক্যবল (প্রযোজ্য) না। সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায় ও সার্কুলারে বলা আছে রায় ইংরেজিতে দেয়া যাবে। আইনি ভাষাগুলো বাংলার চেয়ে ইংরেজির ব্যবহার সহজ। আর এখানে কালচারটা ইংরেজিতে গড়ে উঠেছে। সুপ্রিম কোর্টের রুলসে বলা আছে বাংলা বা ইংরেজিতে দেয়া যাবে।

বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের ৩ (২) ধারায় বলা হয়েছে,৩ (১) উপ-ধারা অনুযায়ী কোন কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহলে তা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। আইনটি পাসের পর থেকে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের দাপ্তরিক আদেশ ও নির্দেশনা বাংলায় হচ্ছে। তবে সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন না হওয়ায় প্রতিকার চেয়ে দায়ের করা হয়েছে একাধিক রিট। হাইকোর্ট রুল জারি করলেও কোনটি চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়নি।

উচ্চ আদালতে সব আবেদন ইংরেজিতে জমা দেয়া হয় কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘অনেকে বাংলায়ও আবেদন দেন। কেননা বলা আছে বাংলা বা ইংরেজিতে আবেদন দেওয়া যাবে। আইনের বই বা সিদ্ধান্তের বেশিরভাগই ইংরেজিতে। আর একটি প্রক্রিয়া থেকে আরেকটি প্রক্রিয়ায় যেতে সময় লাগে। বাংলায় আবেদন করতে বা রায় দিতে কোনো বাধা নেই। অনেকে দিচ্ছেন, অনেকে চেষ্টা করছেন। ভবিষ্যতে হয়তো সব রায়ই বাংলায় পাওয়া যাবে।’

আইনজীবীদের তালিকাভুক্তির পরীক্ষা নিয়ে থাকে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল। সেখানে অধস্তন আদালতে তালিকাভুক্ত হতে বাংলা বা ইংরেজিতে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ থাকে। তবে হাইকোর্টে তালিকাভুক্তির বেলায় তা কেবল ইংরেজিতে দিতে হয়। অর্থাৎ অধস্তন আদালতে সব ক্ষেত্রে বাংলার আধিক্য থাকলেও উচ্চ আদালতে ইংরেজির আধিক্য বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার বলেন, দুজন বিচারপতি সব সময় বাংলায় রায় দেন। আর ফেব্রুয়ারি আসলে কেউ কেউ বাংলায় রায় দেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়গুলো আন্তর্জাতিকভাবে দেখা হয়। নজির হিসেবে অন্যান্য দেশ ফলো করে।

আগে অধস্তন আদালতে অধিকাংশ আবেদনই ইংরেজিতে জমা দেয়া হতো। তবে ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন করার পর অনেকে আদালতে গিয়ে ইংরেজিতে লেখা আরজি খারিজের আবেদন করে বলেন, আইন অনুযায়ী এসব আরজি চলবে না। তাই আরজি খারিজ চান তারা। বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে সিভিল রিভিশন দায়ের করা হয়।

সিভিল রিভিশনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘হাশমত উল্লাহ বনাম আজমিরি বিবি ও অন্যান্য’ মামলার রায়ে হাইকোর্ট বলেন, দেওয়ানি কার্যবিধি একটি বিশেষ আইন এবং এই কার্যবিধির ১৩৭ (২) ধারায় উল্লেখিত বিধান মোতাবেক সরকার কোনো পদক্ষেপ না নিলে ইংরেজিতে আবেদন করতে কোনো বাধা নেই। তাই বাংলা ভাষা প্রচলন আইন থাকা সত্ত্বেও দেওয়ানি আদালতে ইংরেজি চালু রাখা যাবে। রায়টি ৪৪ ডিএলআরেও প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও রায়ে উচ্চ আদালতের ভাষার বিষয়ে কোনো কিছু বলা হয়নি।

হাইকোর্টের ওই রায় চ্যালেঞ্জ করে এখনো পর্যন্ত কেউ আপিল বিভাগে যাননি। তবে ২০১১ সালে আইন কমিশন দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ (২) এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫৮ ধারা সংশোধনের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠায়। কিন্তু সেই সুপারিশ আজও বাস্তবায়িত হয়নি।

দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ (১) ধারায় বলা হয়েছে, সরকার অন্য কোনো নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত অধস্তন আদালতের এই ধরনের ভাষা অব্যাহত থাকবে। ১৩৭ (২) ধারায় বলা হয়েছে, সরকার ঘোষণা করতে পারে যে, কোন আদালতের ভাষা কি হবে এবং আদালতে কীভাবে আবেদন এবং কার্যধারা লিখতে হবে। এছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫৮ ধারায়ও বলা হয়েছে, প্রতিটি আদালতের ভাষা সরকার নির্ধারণ করতে পারে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবু জাহিদ বলেন, হাইকোর্ট বিভাগের রুলস অধ্যায় ৪ এর বিধি–১ এ বলা আছে, ইংরেজিতে অথবা বাংলায় আবেদন করা যাবে। তবে হাশমতুল্লাহ বনাম আজমেরি বিবি ও অন্যান্য মামলার রায়ে উচ্চ আদালতে মামলার আবেদন এবং রায়ের ভাষা কি হবে সেই বিষয়ে কোনো কিছু বলা হয়নি। তাই উচ্চ আদালতে আবেদন এবং রায়ের ক্ষেত্রে অধস্তন আদালতের মতো বাংলার আধিক্য থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে যেকোনো আবেদন বা আপিল মেমো বাংলায় লেখা হলে বাংলায় রায়ের সংখ্যাও এমনিতেই বেড়ে যাবে।

ভারতের সহযোগিতায় ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষায় রায় অনুবাদ করতে ২০২১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘আমার ভাষা’ সফটওয়্যার উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। উদ্বোধনের পর থেকে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেখা যায় মাত্র ৩৩টি রায় বাংলায় অনুবাদ করে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে আপিল বিভাগের ১১টি ও হাইকোর্ট বিভাগের ২২টি রায় রয়েছে।

সফটওয়্যারে রায় অনুবাদে ধীর গতির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন বলেন, সফটওয়্যার দিয়ে অনুবাদ করার পর তা আবার ম্যানুয়ালি দেখে ঠিক করে সংশ্লিষ্ট বিচারপতির কাছে পাঠানো হয়। তারা দেখে দেওয়ার পর তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। আর এই পদ্ধতিটি নতুন। এটি ধীরে ধীরে বাড়বে আশা করি।

এদিকে ইংরেজিতে দেওয়া রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে বাংলায় দেখতে গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রযুক্তিসেবা সংযোজন করা হয়। যার উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তবে অনেক রায়ই বাংলায় দেখা যায় না। আর এতে ভাষা ও শব্দগত কিছু দুর্বলতা দেখা যায়।
এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার বলেন, এটি কারিগরি সমস্যা। আশা করি ধীরে ধীরে তা ঠিক হয়ে যাবে।