খালেদা জিয়া কি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করতে পারবেন?

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৩০ ডিসেম্বর। বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন পেছানোর দাবি করছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সাফ জানিয়ে দিয়েছে ভোটের দিন আর পেছানো সম্ভব না। ক্ষমতাসীন দলও নির্বাচন না পেছানোর পক্ষে। তারা পুরোদমে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আন্দোলনের অংশ হিসেবে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। দলটি এক দশক ধরে নির্বাচনী রাজনীতির বাইরে। দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী বিভিন্ন মামলায় কারাগারে। মামলা এখনও অব্যাহত রয়েছে, বিএনপি যেটিকে গায়েবি মামলা বলছে।

আওয়ামী লীগ যখন আরও কয়েক মাস আগ থেকেই নির্বাচনী গণসংযোগ ও প্রার্থী বাছাইয়ে ব্যস্ত, তখন বিএনপির নিযুত নেতাকর্মী জানেন না দলটি নির্বাচনে যাবে কিনা? দলটির নেতাকর্মীরা গত সপ্তাহে জানতে পারল যে, বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে।

স্বভাবতই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শিবির থেকে অনেকটাই পিছিয়ে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। আওয়ামী লীগ বিভিন্ন জরিপের আলোকে প্রার্থী ঠিক করে রেখেছে। আর বিএনপি এখন পর্যন্ত প্রার্থী বাছাইও করতে পারেনি। আজ শেষ হচ্ছে মনোনয়নপত্র বিতরণ কার্যক্রম।

নির্বাচনের বাকি দেড় মাসের কম। এই সময়ে দল গোছানো, জোটের সঙ্গে আসন বণ্টন, প্রার্থী বাছাই, গণসংযোগ বিএনপির জন্য এক ধরনের চ্যালেঞ্জেই বলা চলে।

তদুপরি দলের দুই শীর্ষ নেতার সরাসরি নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত বিএনপি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একাধিক মামলায় দণ্ডিত হয়ে লন্ডনে অনেকটা নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। তার নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনেকটাই অনিশ্চিত।

আর দলের শীর্ষ নেতা চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির দুই মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাবন্দি। ৮০ দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি বিএনপির রাজনীতিকে অনেকটা এককভাবেই নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। তার কথাই বিএনপিতে শেষ কথা।

৯০-এর পর থেকে প্রতিটি নির্বাচনে খালেদা জিয়া দলের কর্মকৌশল প্রণয়ন ও প্রার্থী বাছাইয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় তার গণসংযোগ বাড়তি উদ্দীপনা সৃষ্টি করে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে।

দলের সেই ‘অবিসংবাদিত’ নেত্রী এবার নির্বাচন করতে পারবেন কিনা, সেটিই এখন বিএনপির নিযুত নেতাকর্মীদের প্রশ্ন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে তিনটি মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করা হয়েছে৷ দুটি মামলায় দণ্ডিত হয়ে তিনি এখন কারাগারে৷ প্রশ্ন হচ্ছে- তিনি কি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন? সংবিধান ও আইন এ ব্যাপারে কী বলছে?

খালেদা জিয়ার জন্য যে তিনটি আসনের মনোনয়ন ফরম কেনা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে- বগুড়া-৬, বগুড়া-৭ ও ফেনী-১৷ ফেনী খালেদা জিয়ার নিজের বাড়ি৷ আর বগুড়া প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও তার স্বামী জিয়াউর রহমানের বাড়ি৷

বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে কারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না, তা বলা আছে৷ সেখানে নানা ধরনের অযোগ্যতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে৷

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২ ধারার ‘ঘ’ উপধারায় বলা আছে-‘কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি… তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে৷’

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুনীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে প্রথমে ৫ বছর এবং পরে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলে হাইকোর্ট সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন৷

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিশেষ আদালত তাকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন৷ খালেদা জিয়া গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে আছেন৷

সংবিধানে কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই যে, মামলায় সাজার রায় কোন পর্যায় থেকে বিবেচনা করা হবে৷ বিচারিক আদালত না সর্বশেষ আপিল আদালতের চূড়ান্ত রায়?

খালেদা জিয়ার দুটি মামলাই সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ, তারপর আপিল বিভাগ এবং তারপর ওই বিভাগেই রিভিউয়ের সুযোগ আছে৷ মামলা দুটি এখন আপিল পর্যায়ে আছে৷

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশেও বলা আছে, কোনো ব্যক্তি কোনো আদালতে দুই বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন৷

তবে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কেউ উচ্চ আদালতে আপিল করলে সেই ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারবেন কিনা, সে বিষয়ে আইনে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি৷

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র বৈধ না অবৈধ, সে বিষযে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রিটার্নিং অফিসারের৷

রিটার্নিং অফিসার কারুর মনোনয়নপত্র অবৈধ বলে বাতিল করলে তার বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আপিল করতে পারবেন৷ কমিশন সেই আবেদন বাতিল করলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন৷ আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবেন কমিশন তা অনুসরণ করবে৷

খালেদা জিয়ার দুই মামলায় দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘সংবিধান ও আইনে বলা হয়েছে- কোনো ব্যক্তির সর্বনিম্ন দুই বছর সাজা হলে নির্বাচন করতে পারবেন না৷ আর শাস্তি বলতে আমরা বিচারিক আদালতের শাস্তি বুঝি৷ কোনো উচ্চ আদালত খালেদা জিয়ার দণ্ড বাতিল বা স্থগিত করেননি৷ তাই আইন অনুয়ায়ী নির্বাচনের অযোগ্য তিনি৷ এখানে আপিল বা অন্য কোনো বিষয় বিবেচনার কথা নয়৷’

একে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া প্রার্থী হতে পারবেন কি পারবেন না, এটি আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দেবেন রিটার্নিং অফিসার৷’

অন্যদিকে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার দু’টি মামলাই আপিল পর্যায়ে রয়েছে৷ আদালতের অনেক রায়ের উদাহরণ আছে যে, আপিল হলে মামলা চূড়ান্ত নিস্পত্তি বলে বিবেচিত হয় না৷ তাই খালেদা জিয়ার মামলার এখনো যেহেতু চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি, তাই তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন৷’

ব্যারিস্টার খোকনের ভাষ্য, ‘খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেয়া হয়েছে৷ আর সরকার উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচার করছে তিনি নির্বাচন করতে পারবেন না৷’

এদিকে সোমবার নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম খালেদা জিয়াকে নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মনোনয়নপত্রের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রিটার্নিং কর্মকর্তার৷ তিনি যেখানে ভোট করতে মনোনয়নপত্র জমা দেবেন, সেই আসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন৷ তিনি রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট না হলে কমিশনে আপিল করতে পারবেন৷ আমরা পূর্ণাঙ্গ কমিশন বসে ওই আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব৷ রায় বিপক্ষে গেলে তার আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে৷’

খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ না নিতে পারলে আলোচনা আছে তার পরিবারের কেউ ওই তিনটি আসনে নির্বাচন করবেন। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার বড় পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান নির্বাচন করতে পারেন। যদিও তার দেশে আসা নিয়েও রয়েছে সংশয়।