জামায়াতের বিচার ও নিষিদ্ধের শুনানি নিয়ে অনিশ্চয়তা

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা জামায়াতে ইসলামীর বিচার বা দলটিকে নিষিদ্ধ করার বিষয় ব্যাপক আলোচনা থাকলেও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে করা আবেদনের ওপর শুনানি অনিশ্চিত, আবার সরকারও আদালতের কথা বলে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে না।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে ১৯৭১ সালে দল হিসেবে জামায়াতের অপরাধের প্রসঙ্গ এসেছে। সেই সঙ্গে দলটির বিচারের ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এই দলটি চরিত্র ৭১ সালের থেকে এখনও বদলায়নি-এমন মন্তব্য করে ট্রাইব্যুনাল একে নিষিদ্ধের ইঙ্গিত দিয়েছে বলেও মনে করা হয়ে থাকে।

কিন্তু জামায়াতের বিচার এবং নিষিদ্ধের বিষয়ে আদালতের পরবর্তী সিদ্ধান্ত পড়েছে আইনি জটিলতায়।

জামায়াত নিষিদ্ধ করতে উচ্চ আদালতে একটি আবেদন ঝুলে আছে চার বছরেরও বেশি সময় ধরে। আর আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন না করায় জামায়াতের বিচারও আটকে আছে।

গত ৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে তার কাছে জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে জানতে চান একজন সাংবাদিক। জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি আবেদন আছে। আদালতের আদেশের পরেই সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেছেন, ‘জামায়াত এর আগেও নিষিদ্ধ ছিল। তবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সুযোগ পেয়ে ঠিকই তারা আবার রাজনীতিতে ফিরেছে। আমরা জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে দিতেই পারি, কিন্তু পরে বিএনপি যদি কখনও আবার ক্ষমতায় আসে, তাহলে তারা আবার দলটিকে রাজনীতি করার সুযোগ দেবে না, সে নিশ্চয়তা কোথায়? এ কারণে আমরা চাই আদালত থেকে সিদ্ধান্ত আসুক। সে সিদ্ধান্ত তো আর পাল্টানো যাবে না।’

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা জামায়াতের বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার থাকতে পারে না। তার মন্ত্রণালয় জামায়াত নিষিদ্ধে সব প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে।

বিচার নিয়ে আইনি বিতর্ক

২০১৩ সালের শেষ দিকে দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের বিষয়টি নিয়ে প্রক্রিয়া শুরু হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ২০১৪ সালের মার্চে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা তাদের প্রতিবেদন চূড়ান্তও করে।

কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে করা আইনে ব্যক্তির সাজার বিষয়ে বলা থাকলেও সংগঠনের সাজার বিষয়ে কিছু বলা নেই। আর এই আইন সংশোধনের আগে এই বিচার করা সম্ভব হয় বলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একাধিকবার বলেছেন।

আর ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের বিচার আটকে যাওয়ার পর থেকেই আইন সংশোধনের বিষয়ে বলে আসছেন আইনমন্ত্রী। কিন্তু প্রায় চার বছর ধরে তিনি এই কথা বলে আসলেও আইন সংশোধন কবে চূড়ান্ত হবে সেটি নিশ্চিত করতে পারেননি।

তবে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলে আসছেন, দল হিসেবে জামায়াতের বিচারে আইন সংশোধনের দরকার নাই। কারণ বিদ্যমান আইনেই বলা আছে, দণ্ডিতের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল তার ইচ্ছা অনুযায়ী সাজা দিতে পারে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক ছানাউল হক বলেন, ‘জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা করার পর আমরা তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনকে জমাও দিয়েছি। প্রসিকিউশন আমাদেরকে জানায়নি কেন এটা আটকে আছে।’

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়কেরও মত যে, বিদ্যমান আইন সংশোধন না করেই জামায়াতের বিচার সম্ভব। তবে তিনি মনে করেন, সংগঠন দোষী সাব্যস্ত হলে সাজা কী হবে-সে বিষয়ে একটি আইন থাকা উচিত।

জামায়াত নিষিদ্ধের আবেদনের শুনানি অনিশ্চিত

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে বয়সের কারণে করুণা দেখিয়ে মৃত্যুদণ্ডের বদলে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইুব্যনাল। তবে ২০১৩ সালে তার মৃত্যুদণ্ড চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এই আপিলের সঙ্গে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের আর্জি জানানো হয়। তবে গোলাম আযম মারা যাওয়ায় তার সাজা বাড়ানোর বিষয়ে আবেদনের ওপর শুনানি আর হয়নি। এখন জামায়াত নিষিদ্ধের অংশটুকু নিয়ে শুনানি করা যাবে কিনা সে বিষয়েও আইনজীবীরা কিছু জানাতে পারেননি।

এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘মামলার নথি না দেখে বিষয়টি বলা যাবে না।’

এই আপিল দায়ের পর এক সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এম কে রহমান বলেছিলেন, ‘আপিলে আমরা জামায়াত নিষিদ্ধের প্রার্থনা করেছি। ট্রাইব্যুনাল পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন জামায়াতে ইসলামী অপরাধী সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। দীর্ঘ ৪২ বছরেও তারা মুক্তিযুদ্ধের ওপর তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি। জনগণের কাছে তারা দুঃখ প্রকাশও করেনি। এসব পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তিতে ও সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের আলোকে আমরা কমপ্লিট জাস্টিস চেয়েছি। বলেছি, পূর্ণ বিচারের নিমিত্তে জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক।’

অবশ্য একটি ধর্মভিত্তিক দলের আবেদনের পর নির্বাচন কমিশনে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। ফলে দলটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার অধিকার হারিয়েছে। যদিও জামায়াত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে, তবে এর শুনানি এখনও হয়নি।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যা বলেছে

আন্তর্জতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গোলাম আযমের আমৃত্যু কারাদণ্ড ঘোষণার রায়ে বলা হয়, ‘দালিলিক প্রমাণ ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, গোলাম আযমের নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে ইচ্ছাকৃতভাবে একটি অপরাধী সংগঠনের মতো কাজ করেছে, বিশেষ করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে।’

‘বিভিন্ন নথি ও সাধারণ ধারণা থেকে দেখা যায়, অভিযুক্ত গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াত ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো প্রত্যক্ষভাবে একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর স্বাধীনতাবিরোধী চক্রটি এখনো সক্রিয়। আর এর ফলে নতুন প্রজন্মের জামায়াত-সমর্থকেরাও মনস্তাত্ত্বিকভাবে স্বাধীনতাবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় দুষ্ট। আমাদের জাতির কাছে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে একাত্তরে জামায়াত যে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা পালন করেছিল, তাদের সেই মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে এবং ৩০ লাখ শহীদের প্রতি সমবেদনা ও শ্রদ্ধার কোনো নিদর্শন তারা এখনো দেখায়নি।’

পাঁচ শীর্ষ নেতার ফাসি কার্যকর, আপিলে আরও দুই

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এরই মধ্যে জামায়াতের পাঁচ শীর্ষ নেতার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এরা হলেন আলবদর নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মীর কাসেম আলী, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং আবদুল কাদের মোল্লা। আরও দুই নেতা আবদুস সুবহান এবং এটিএম আজহারুল ইসলামের ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে আপিল চলছে। আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। আর আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় চলাকালে মারা গেছেন বাংলাদেশে জামায়াতের গুরু গোলাম আযম, বিচার শুরুর আগেই মারা গেছেন রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ।

জামায়াতের নেতাদের সাজা দাবিই গত কয়েক বছর ধরে প্রধান হয়ে উঠেছিল। আর তাদের সাজা হওয়ার পর দল হিসেবে জামায়াতের বিচার ও তাদের নিষিদ্ধের দাবি প্রতি জাতীয় দিবসেই বড় হয়ে দেখা দেয়।

নিষিদ্ধ জামায়াতকে রাজনীতিতে ফিরিয়েছেন জিয়াউর রহমান

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা জামায়াত যুদ্ধের পর পর নিষিদ্ধই ছিল। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসা জিয়াউর রহমানের আমলে জামায়াত রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ পায়। এর আগে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি করার অধিকার ছিল না।

জামায়াত আইনি বৈধতা পাওয়ার পর থেকেই এই দলটিকে আবার নিষিদ্ধের দাবি উঠে। একই সময়ে জিয়াউর রহমানের সিদ্ধান্তে দালাল আইনের বিচার বন্ধ করে সাজাপ্রাপ্ত এবং বন্দীদের মুক্তি দেয়ার পর থেকে একইভাবে বিচার উঠে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেরও।

প্রতিষ্ঠার পরে তিনবার নিষিদ্ধ হয় জামায়াত

১৯৪১ সালে জামায়াতের প্রতিষ্ঠা করেন বিতর্কিত ইসলামী চিন্তাবিদ সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী। ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিল মওদুদীর জামায়াত। তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর জামায়াত ধর্মকে পুঁজি করেই তার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে এই দেশে। আবার পাকিস্তানে আহমদিয়াবিরোধী দাঙ্গা বাঁধানোর অভিযোগে মওদুদীর ফাঁসির আদেশও হয়েছিল। পরে সৌদি বাদশাহের বিশেষ অনুরোধে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।

রাজনৈতিক দল হিসেবে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মিলিয়ে তিনবার নিষিদ্ধ হয়েছিল জামায়াত।। প্রতিষ্ঠার ১৮ বছরের মাথায় ১৯৫৯ সালে প্রথম বার এবং ১৯৬৪ সালে দ্বিতীয়বার নিষিদ্ধ হয় দলটি। আর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরার অপরাধে তৃতীয়বার নিষিদ্ধ হয় ১৯৭২ সালে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৭৯ সালের ২৫ মে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে প্রকাশ্যে রাজনীতির সুযোগ পায় জামায়াত।-সৌজন্যে : ঢাকাটাইমস