ধর্ষণ থামার লক্ষণই নেই ভারতে

রোববার। ২০১২ সালের এইদিনে বাসে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ২৩ বছর বয়সী ফিজিওথেরাপি ইন্টার্ন ছাত্রী জ্যোতি সিংহ পান্ডে। তিনি যখন তার ছেলেবন্ধু অন্দ্র প্রতাপ পান্ডের সঙ্গে একটি বেসরকারি বাসে ভ্রমণ করছিলেন তখন তাকে পিটুনি দেয়া হয় এবং তারপর তাকে গণধর্ষণ করা হয়। ওই বাসে চালকসহ আরও ৬ জন ছিলেন যাদের প্রত্যেকেই পান্ডেকে ধর্ষণ করে এবং তার বন্ধুকে পিটুনি দেয়।

ঘটনার ১৩ দিন পর তাকে জরুরি চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এর দুইদিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান পান্ডে। এই ঘটনাটি ভারত এবং ভারতের বাইরে ব্যাপক সাড়া জাগায়।

ধর্ষণের প্রতিবাদেও ধর্ষকদের শাস্তি দাবি করে প্রচুর সভা সমাবেশ ও প্রতিবাদ হতে দেখা যায়। গত রোববার ছিল ওই ঘটনার ৬ বছর। ওই ঘটনার পর ছয়টি বছর পেরিয়ে গেলেও দোষীরা শাস্তি পায়নি। পরিবর্তন হয়নি নারীদের প্রতি ভারতবাসীর দৃষ্টিভঙ্গি। ঠিক যেই দিন জ্যোতি পান্ডের ধর্ষণের ৬ বছর পূর্ণ হলো ঠিক সেইদিন ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩ বছর বয়সী এক অবুঝ শিশু।

বাড়ির মেঝেতে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ময়লা পোশাকে শিশুটিকে পরে থাকতে দেখেন তার বাবা। পরে তাকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

বর্তমানে শিশুটির অবস্থা স্থিতিশীল। ধারণা করা হচ্ছে ৪০ বছর এক নিরাপত্তাকর্মী শিশুটিকে ধর্ষণ করেছে। বিষয়টি এখন তদন্তাধীন।

ভারতে এভাবে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। এ পাশবিক কাজ থেকে রেহাই পাচ্ছে না ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধা কিংবা দুধের শিশু। দিন যত যাচ্ছে এ পাশবিক কর্ম যেন বেড়েই চলেছে। তারপরও ভারত সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে না।

দেশটির ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, পুলিশের কাছে প্রতিদিন প্রায় একশোটির মতো যৌন হয়রানির অভিযোগ আসছে। ২০১৬ সালে দেশটিতে ৩৯ হাজার যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। বলা হচ্ছে, ওই বছরটিতে বিগত বছরের তুলনায় শতকরা ১২ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে এ ধরনের ঘটনা।

গত সপ্তাহে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রে ব্রিটেনের এক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই নারী জানিয়েছেন, তিনি হোটেলে ফেরার পথে ধর্ষণের শিকার হন।

দিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর সোসাল রিসার্চ এর পরিচালক রঞ্জনা কুমারি বলেন, ‘নারীদের সুরক্ষার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে রাজনৈতিক ইচ্ছার চরম শৈথিল্য রয়েছে। এ বিষয়ে অনেক প্রতিশ্রতি নারীরা শুনেছেন। কিন্তু তার কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি।’

‘আমরা প্রায়ই শুনে থাকি যে, আইন করে দোষীদের কঠিন শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু আমি বলতে চাই-আইন তো আমাদের রয়েছে। শুধু যথার্থ প্রয়োগ নেই’-যোগ করেন কুমারি।

এপ্রিলে জম্মু-কাশ্মিরের উত্তরাঞ্চলের একটি এলাকায় আট বছর বয়সী এক শিশুকে জোরপূর্বক নেশাজাতীয় দ্রব্য খাওয়া হয়। পরে গণধর্ষণ ও শ্বাসরোধ করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় আটজনকে আটক করে পুলিশ এবং তারা সবাই হিন্দু। পুলিশ জানিয়েছে, অঞ্চলটি থেকে মুসলমানদের তাড়িয়ে দিতে তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানোর উদ্দেশেই তারা শিশুটিকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণ শেষে হত্যা করে।

এ ঘটনার ক্ষোভের বিস্ফোরণ পুরো ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভের মুখে দুইজন মন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

নতুন আইন করে সরকার। এতে বলা হয়, কেউ ১২ বছরের নিচে কোনো শিশুটিকে ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে তার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড।

এর পরেও দেশটিতে থামেনি ধর্ষণের ঘটনা। প্রায়ই প্রতিদিন ভারতে ধর্ষণের ঘটনা শোনা যায়। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, আইন আছে, তবে আইনের যথার্থ প্রয়োগ না থাকার কারণে ধর্ষণের লাগাম টানা যাচ্ছে না।

ভারতজুড়ে যেসব নারী যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন এবং আইনের আশ্রয় নিয়েছেন তাদের নিয়ে প্রতিবেদন তৈরিতে কাজ করছেন জয়শ্রী বাজোরিয়া। সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে তিনি বলেন, ‘এসব ঘটনায় আইন পাস হলেও আসলে পদ্ধতিগত পরিবর্তন এখনও আসেনি। আমাদের দরকার আইনের প্রয়োগ এবং এটাই এই সমাজে অনুপস্থিত। আমাদের দুভার্গ্য যে, জ্যোতি পান্ডের ঘটনার ৬ বছর পর এখনও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি।’