বাংলাদেশে কন্যাশিশুর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কী বদলেছে?

কন্যা শিশুর ব্যাপারে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টানোর জন্য বাংলাদেশে সরকারী-বেসরকারি উদ্যোগে প্রচারণা চলছে গত কয়েক দশক ধরে।

প্রাথমিক শিক্ষায় এর ফলে মেয়ে শিশুদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, এই মূহুর্তে বাংলাদেশে স্কুল শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি।

কিন্তু জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা, ইউনিসেফের হিসেবে, বাংলাদেশে এখনো ৫৯ শতাংশ মেয়েরই বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়স হবার আগেই।

তাহলে কন্যা শিশুর ব্যাপারে বাংলাদেশে মনোভাব কতটা পাল্টেছে?

ঢাকার পল্লবীতে গৃহকর্মীর কাজ করেন বরিশালের মেয়ে আসমা বেগম। কিশোরী অবস্থায় পরিবারের দারিদ্রের কারণে ১৭ বছর আগে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন।

ক্রমে বিয়ে হয়েছে, সন্তান হয়েছে। কিন্তু পরিবারে দারিদ্র এখনো আছে। কিন্তু তবু নিজের ১২ বছর মেয়েটিকে কোন বাসাবাড়িতে কাজে না দিয়ে স্কুলে পড়াচ্ছেন।

“বাচ্চা নিয়া অনেক কষ্ট করছি, ছয়দিনের বাচ্চা নিয়া মানুষের বাসায় কাজ করছি। অনেকে বলছে মেয়েরে পালতে দিতে দেই নাই। এখন মানুষের বাড়িতে কাজেও দিই নাই। সব মায়ের মতই আমিও চাই, পড়ালেখা যেইটুক পারে কইরা যদি একটা ছোটখাটো চাকরি পায়, নিজের পায়ে দাঁড়াইতে পারবে, সেইজন্য।”

সমাজে মেয়ে বা কন্যাশিশুর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কতটা বদলেছে আসমার বেগমের পরিবারের গল্পটি তার একটি উদাহরণ মাত্র। মাত্র এক দশক আগেও এই চিত্র ভিন্ন রকম ছিল।

তবে, নারী অধিকার কর্মী এবং গবেষকদের মতে, কন্যাশিশুর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি সব ক্ষেত্রে বদলায়নি। যদিও শিক্ষা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে।

বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, পরিবর্তনের একটি কারণ অর্থনৈতিক, অর্থাৎ সমাজে নারীর অর্থনৈতিক অবদান বৃদ্ধি পাবার কারণেই বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বাবা মায়েরা দেখছেন, অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েরা পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারে।

যেকারণে মেয়ে বাচ্চাদের শিক্ষিত করে তোলার একটা চেষ্টা থাকে, বলছেন মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নীনা গোস্বামী

“দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা বদলেছে। যখন কোন মা-বাবা দেখছে মেয়েরা বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে পারছে, তখন তারা আশ্বস্ত হচ্ছেন। শিক্ষিত সমাজে মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা বেশি দেখা যায়, কিন্তু তার বাইরেও এমন ঘটনা আছে। দেশের বিপুল সংখ্যক গার্মেন্টস কর্মীও এ দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সাহায্য করছে।”

বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতে যেসব মেয়েরা কাজ করতে আসেন তাদের একটি বড় অংশের বয়স কুড়ি বছরের নিচে। মিজ গোস্বামী বলছেন, কিছু অগ্রগতি যেমন রয়েছে, সেই সঙ্গে বাংলাদেশে নির্যাতনের শিকার নারীদের একটি বড় অংশের বয়সই ১৫ বছরের নিচে, এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্যাতনের সেই হারও বেড়েছে

“নারীর অধিকার পাওয়ার চিত্র এবং নারীর নিরাপত্তা পাওয়ার চিত্রে কিন্তু খুব একটা বদল আসেনি। নারীরা ঘর থেকে যখন বের হয়ে আসছে, সমাজের একটা অংশ এখনো সেটা ভালোভাবে নেয় না। যে কারণে মেয়েরা রাস্তায়, যানবাহনে নির্যাতনের শিকার হয়।”

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত সারাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে অন্তত ১৬ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এসব নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে শারীরিক, মানসিক নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যা।

একই সাথে বাংলাদেশে এখনো বাল্যবিয়ের হার পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে বেশি। এ বছরের মার্চে প্রকাশিত ইউনিসেফের হিসাব বলছে, বাংলাদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়েই বাল্যবিবাহের শিকার হয়। যদিও সরকারি হিসাব বলছে, এই হার ৫২ শতাংশ, আর এ সংখ্যা ক্রমে আসছে বলে দাবি করছেন সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম এনডিসি।

“বাল্য বিবাহের হার অনেক কমেছে এখন দেশে এবং সিলেট বিভাগকে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। বাল্যবিবাহের ওপর আমাদের চালানো পাঁচটি ‘জাতীয় প্রচারণা’ চলছে সব কয়টি আন্তর্জাতিক পুরষ্কার জিতেছে।”

“এছাড়া ইতোমধ্যেই আমাদের বাল্যবিবাহ বিধিমালা প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে, এবং এ বিষয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার বিষয়টিও এখন গেজেট প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।”

সচিব নাসিমা বেগম জানিয়েছেন, সরকার সাড়ে পাঁচশো কোটি টাকা খরচ করে দেশের সব উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে কিশোর-কিশোরী ক্লাব গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে, যেখানে মূলত কন্যা শিশুদের শিক্ষা এবং মানসিক বিকাশের জন্য নানা ধরণের কর্মকান্ড পরিচালনা করা হবে।

-বিবিসি বাংলা