ভারতীয় গরুর শিংয়ে অগ্রিম বুকিং

ভারতীয় গরুর আঁকাবাঁকা সুন্দর শিং পেতে মানুষের আগ্রহের যেন কমতি নেই। সৌখিন ব্যক্তিরা বিশাল আকারের এ শিং পেতে অগ্রিম বুকিং দিচ্ছেন। প্রয়োজনে উল্লেখযোগ্য অর্থ খরচ করতেও রাজি তারা। রাজধানীর গাবতলী গরুর হাট ঘুরে এমন তথ্য জানা গেছে।

শনিবার গাবতলী গরুর হাটে প্রবেশ করতেই টিনশেড ছাউনির নিচে ভারতীয় জাতের গরুর খামার দেখতে পাওয়া যায়। কোরবানি উপলক্ষে গরুগুলো পালন করা হচ্ছে। ভারতীয় জাতের ছোট সাইজের গরু এখানে বছরজুড়ে মোটাতাজা করা হয়। ঈদে বেশি দামে সেগুলো বিক্রি করা হয়।

খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারতীয় গরুর বিশাল শিং মূলত বাসাবাড়িতে শোপিস বা ওয়ালমেট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত দেশি জাতের গরুর শিং এত বড় হয় না। কিন্তু ভারতের রাজস্তান থেকে আনা এসব গরুর শিং হয় বড়। এগুলো যেভাবে এঁকেবেঁকে বেড়ে ওঠে- সত্যিই তা দেখার মতো। এ কারণে সৌখিন মানুষের পছন্দের তালিকায় থাকে ভারতীয় গুরুর এ শিং। এজন্য মোটা অংকের অর্থ খরচ করতেও কেউ পিছপা হন না।

কথা হয় গরুব্যবসায়ী ইকবালের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, গত সপ্তাহে সিটি কর্পোরেশনের এক বড় সাব (কর্মকর্তা) এসেছিলেন শিং নিতে। বলে গেছেন, যে করেই হোক তাকে যেন বিশাল আকৃতির গরুর শিং দেয়া হয়। এজন্য তিনি মোবাইল নম্বর দিয়ে গেছেন।

তার ভাষায়, ‘আমি বড় সাবকে কইছি, আশপাশে এ গরু জবাই হলে ফোন কইরা জানামু। হুনেন ভাই, এর আগে চারজন মানুষ ট্যাহা (টাকা) দিয়া গেছে। হেরাও কম না। হেডামওলা (ক্ষমতাবান) ব্যক্তি। একজনকে পরশুদিন একজোড়া শিং দিছি।’

সরেজমিন দেখা গেছে, ভারতীয় এসব গরুর শিং দেখলে যে কারও মনে ধরবে। যেমন সাইজ গরুর, তেমনি তার শিং। মূলত শিং গরুকে আলাদা একটি সৌন্দর্য এনে দেয়। ভারতীয় গরুর শিং পেতে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অফার করারও রেকর্ড রয়েছে- জানান জাহাঙ্গীর নামের অপর এক ব্যবসায়ী।

জানা গেছে, গরুর কোনো কিছুই ফেলনা নয়। অনেক বাসাবাড়িতে আগে ওয়াল শোপিস হিসেবে হরিণের চামড়া ও শিং ব্যবহার দেখা যেত। হরিণ শিকার দণ্ডনীয় অপরাধ হওয়ায় এখন আর সেগুলো তেমন পাওয়া যায় না। ফলে বিকল্প হিসেবে বড় আকৃতির গরুর শিংয়ের প্রতি সৌখিন মানুষের আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। দেশি গরুর চেয়ে ভারতীয় গরুর শিং সাইজে বড় হওয়ায় এর প্রতি মানুষের ঝোঁকও বেশি।

মাংসের বাইরে এসব পশুর হাড়, খুর, দাঁত, লেজ, রক্ত, পাকস্থলী, পিত্তথলি, অণ্ডকোষ প্রভৃতি প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশেও রফতানি করা হয়।

ব্যবসায়ীরা জানান, একটি মাঝারি আকারের গরু থেকে প্রায় ১৮-২২ কেজি এবং মহিষ থেকে ২৫-৩০ কেজি হাড় পাওয়া যায়। যার প্রতি কেজির বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ২২-২৫ টাকা। সেই হিসেবে শুধু হাড় থেকেই গরুপ্রতি আয় প্রায় ৫০০ টাকা।

রফতানিকারকরা জানান, জবাইয়ের পর একটি পশুর উচ্ছিষ্ট প্রক্রিয়াজাত করার পর এর রফতানি মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ২০ ডলার বা ১৬০০ টাকার কাছাকাছি। দেশে বছরে গড়ে এক কোটি গরু-মহিষ জবাই হয়। সেই হিসাবে এসবের বাজারমূল্য প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

তারা আরও জানান, বর্তমানে বছরে ১০০ কোটি টাকার পশুর উচ্ছিষ্ট রফতানি হচ্ছে। এর মানে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার উচ্ছিষ্ট ডাস্টবিনে পড়েই নষ্ট হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, চীন, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে পশুর উচ্ছিষ্ট অংশ। অণ্ডকোষ দিয়ে তৈরি হয় জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাদ্য ‘সুসেড রুল’। বিভিন্ন দেশে গবাদি পশুর লিঙ্গ দিয়ে তৈরি হয় উৎকৃষ্ট মানের উপাদেয় সুপ। বাংলাদেশ থেকে প্রতিটি পশুর লিঙ্গ তারা কিনছে পাঁচ থেকে ছয় ডলারে। তাই এ অঙ্গটি থেকেই বছরে ৫০০ কোটি টাকা আয় সম্ভব।

গরুর রক্তনালি দিয়েও তৈরি হয় উপাদেয় খাবার। পাশাপাশি হাড়, খুর, দাঁত, শিং আর রক্ত দিয়ে তৈরি হয় জেলোটিন, ক্যামেরার ফিল্ম, সিরিস কাগজ ও পশু-পাখির খাবার। পায়ের খুর দিয়ে তৈরি হয় অডিও-ভিডিওর ক্লিপ। হাড় ও শিং চিরুনি ও পোশাকের বোতাম তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও হাড় ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া জার্মানি ও ইতালিতে শিংয়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

এখন হাড় ও শিং ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে সৌখিন গৃহসজ্জার সামগ্রী। অন্যদিকে হাড়ের পাউডার বা দানা জাপান, চীন, কোরিয়া, মিয়ানমার ও হংকংয়ে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় হচ্ছে।