মঙ্গল শোভাযাত্রার বাংলাদেশ | প্রভাষ আমিন
বাংলাদেশে যতগুলো উৎসব আছে, আমার সবচেয়ে প্রিয় বর্ষবরণ। এই একটি উৎসবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ মন খুলে অংশ নিতে পারে। এমনকি আদিবাসীরাও বৈসাবী উৎসব নিয়ে শামিল হয় বাংলা বর্ষবরণে। এই একটি দিনে বাংলার ঘরে ঘরে আনন্দের বান ডাকে যেন। আমাদের এ অঞ্চলে উৎসবের কমতি নেই। ছেলেবেলায় আমরা সব উৎসবেই শামিল হতাম।
মুসলমানদের দুই ঈদের উৎসব তো আছেই। আমরা শবে কদর, শবে মেরাজ, শবে বরাতকেও উৎসব বানিয়ে ফেলতাম। এই তিনটি উৎসবই রাতে। তাই আমরা অবধারিতভাবে রাতে ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা পেয়ে যেতাম। ছুটিটা পেতাম আসলে মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য। কিন্তু মসজিদে একটু হাজিরা দিয়ে আমরা রাতভর ঘুরে বেড়াতাম। রাতে বাইরে থাকার আনন্দটাই অন্যরকম। এর মধ্যে শবে বরাতে উৎসবটা বেশি হতো। সন্ধ্যার পর গোসল করে ঘরে ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করতাম।
আর হিন্দু সম্প্রদায়ের তো বারো মাসে তেরো পূজা। তার অনেকটিতে আমরা অংশ নিতাম। আমাদের ছেলেবেলা ছিল উৎসবময়। আমাদের এলাকায় অন্য ধর্মের মানুষ ছিল না বলে বড়দিন বা প্রবারণা পূর্ণিমার আনন্দটা ছেলেবেলায় মিস করেছি। কিন্তু বড় হয়ে দেখেছি, বড়দিনের ক্রিসমাস ট্রি বা সান্তা ক্লজের উপহার আর প্রবারণা পূর্ণিমার ফানুস ওড়ানোও কম আনন্দের নয়। ধর্মীয় প্রার্থনার অংশটুকু বাদ দিলে, সব ধর্মের সব উৎসবই আনন্দের, আমাদের সবার। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। তবে পয়লা বৈশাখের উৎসবের কোনো তুলনা নেই। সব ধর্মের মানুষ মন খুলে এ উৎসবে মেতে উঠতে পারে। গ্রামে গ্রামে বৈশাখী মেলা, হরেক খাবার, হরেক খেলনা, নাগরদোলা; সত্যিই যেন আনন্দের মেলা বসে।
বাংলাদেশে তিনটি সাল আমরা ব্যবহার করি। আমাদের ধর্ম, জাতীয়তা বা সংস্কৃতির সঙ্গে যার কোনো মিল নেই, সম্পর্ক নেই; সেই খ্রিস্টাব্দ ব্যবহার করি সবচেয়ে বেশি। অফিস, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্রই খ্রিস্টাব্দের জয়জয়কার। আমরাও ইংরেজি মাসের তারিখ যতটা জানি, বাংলা বা হিজরি মাসের তারিখ ততটা জানি না। খ্রিস্টাব্দে ‘নিউ ইয়ার’ যতটা উদযাপিত হয়, তার চেয়ে বেশি হয় ‘থার্টি ফার্স্ট’। হিজরি সাল বা আরবি ক্যালেন্ডার প্রতিদিন না লাগলেও আমাদের নিয়মিতই লাগে। ইসলাম ধর্মের সব হিসাব-নিকাশ এই চান্দ্র মাস বা হিজরি সাল ধরেই হয়। তবে হিজরি সালে নববর্ষ বা নিউ ইয়ার উদযাপনের রেওয়াজ নেই। বরং হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মহররম আসে কারবালার শোকাবহ স্মৃতি নিয়ে। তবে বাংলা বছরের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ আমাদের জীবনে আসে উৎসবের ডালি সাজিয়ে গানে, মেলায়, উৎসবে, রঙে অনন্য হয়ে।
অতি মুসলমান বা মৌলবাদীদের কেউ কেউ পয়লা বৈশাখকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি বলেন, এর বিরোধিতা করেন। কিন্তু বাংলা সনের সঙ্গে কোনো ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। কিছুটা সম্পর্ক থাকতে পারে ইসলাম ধর্মের সঙ্গে। কারণ বাংলা সন গণনা চালু করেছিলেন মোগল সম্রাট আকবর। বাংলা সনের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক হলো কৃষিকাজের, কৃষকের। শুরুতে এটাকে ফসলি সনও বলা হতো। ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য শুরুর পর হিজরি সাল অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় হতো।
কিন্তু হিজরি সাল চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলতো না। প্রতিবছরই হিজরি সালে দিনের ওলটপালট হয়ে যায়। তাই কৃষকদের ওপর অসময়ে খাজনা দেওয়ার চাপ তৈরি হতো। এই ঝামেলা মেটাতেই সম্রাট আকবরের নির্দেশে প্রাচীন বর্ষপঞ্জি সংস্কার করে ফসলি সন বা বাংলা সন চালু করা হয়। আর এই সংস্কারের কাজটি করেছিলেন তখনকার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি। তিনি সৌর সন এবং আরবি হিজরি সালের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম চালু করেন।
আকবরের সময় থেকেই পয়লা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। সকল দেনা মিটিয়ে পয়লা বৈশাখ শুরু হতো নতুন আশা নিয়ে। ব্যবসায়ীরা নতুন বছর শুরু করতেন নতুন খাতা দিয়ে, যেটাকে বলা হয় হালখাতা। হালখাতা উৎসবও হয়। ব্যবসায়ীরা পাওনা আদায়ে উৎসব করতেন। মনে আছে ছেলেবেলায় মামার হাত ধরে ছালিয়াকান্দি বাজারে হালখাতা উৎসবে যেতাম রসগোল্লার লোভে।
পয়লা বৈশাখের সঙ্গে হিন্দুয়ানির কোনো সম্পর্ক নেই। যে দুজনের নাম আছে- একজন সম্রাট, একজন জ্যোতির্বিদ, দুজনই মুসলমান। পয়লা বৈশাখের উৎসবটা হিন্দুয়ানি যেমন নয়, ইসলামিকও নয়; পয়লা বৈশাখ খাটি বাঙালির সংস্কৃতি, এই মাটির সংস্কৃতি। আমরা শহুরে লোকজন যতই দেয়ালে ইংরেজি ক্যালেন্ডার ঝুলিয়ে রাখি, গ্রামের মানুষের সব হিসাব কিন্তু বাংলা সনে। তাদের ক্যালেন্ডার লাগে না, আকাশ আর প্রকৃতি দেখেই মাস-ঋতুর হিসাব মেলায়। বাংলা মাসগুলোকে গ্রামের মানুষ ডাকেও নিজেদের মতো করে। জ্যৈষ্ঠ মাস তাদের ভাষায় জষ্ঠি, কাতি মানে কার্তিক, অগ্রহায়ণকে ডাকে আগুন, ফাল্গুনকে ফাগুন, আর চৈত্র হলো চইত মাস। বৃষ্টি-বাদলা, ঝড়-বন্যা-খরার হিসাব তাদের মুখস্থ। প্রকৃতির দিকে তাকালেই বোঝা যায় কোন ঋতু চলছে। কৃষ্ণচূড়ার মতো কড়া রঙের ফুল মানেই গ্রীষ্মকাল, গন্ধরাজের মতো সুগন্ধী মানেই বর্ষা, কাশ মানেই শরত, পলাশ মানেই ফাল্গুন।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। ধর্মকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল পাকিস্তান। যার দুই অংশের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব ছিল ১১০০ মাইল, মানসিক দূরত্ব ছিল অনতিক্রম্য। পশ্চিম পাকিস্তানিরা শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি অধিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর হামলা চালায়। প্রথম আঘাতটা আসে ভাষার ওপর। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলার বদলে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা হলে বাঙালি রক্ত দিয়ে সে ষড়যন্ত্র রুখে দেয়। কিন্তু ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। আরবি হরফে বাংলা লেখা, বাংলা ভাষা থেকে ‘হিন্দুয়ানি’ শব্দ ছেঁটে ফেলা, লেখকদের লেখায় শব্দ বদলে দেওয়ার মতো উদ্ভট উদ্যোগও হয়েছে। সবচেয়ে বড় আঘাতটা আসে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের সময়। সামরিক শাসকরা চেষ্টা করে রবীন্দ্রনাথকেই নিষিদ্ধ করার। এমনকি তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের বলা হয়, তারা কেন রবীন্দ্রসংগীত লিখছে না। সরকারের রবীন্দ্রবিরোধী এই উদ্যোগে তাল দিয়েছিলেন এ দেশেরই কিছু বুদ্ধিজীবী। তবে সেই অন্ধকার সময়ে আলোকবর্তিকা হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন বুদ্ধিজীবীরাই। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের পর এক বনভোজনে গিয়ে গঠিত হয় ছায়ানট, যা গত ৫৬ বছর ধরে আলোর সেই মশালটি ধরে রেখেছে। ১৯৬১ সালে গঠিত হলেও ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট শুরু করে বাংলা বর্ষবরণের আয়োজন।
রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখের ভোরে ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন এখন বাঙালির সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় ঐতিহ্য। আর তাই ছায়ানট সবসময়ই প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্ষুশূল। সংস্কৃতির এই অনাবিল আয়োজন গায়ে জ্বালা ধরায় মৌলবাদীদের, জঙ্গিদের। ২০০১ সালে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজনে জঙ্গি হামলায় প্রাণ দিয়েছিলেন ১০ জন। তবে এই হামলায় মানুষকে আটকানো যায়নি। ছায়ানটের বর্ষবরণকে ঘিরে রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় উৎসবমুখরতার যে বান ডাকে তা আমাদের সাহস জোগায় অন্ধকারের বিরুদ্ধে, অশুভের বিরুদ্ধে, প্রতিক্রিয়াশীলতার বিপক্ষে, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে।
ছায়ানটের বর্ষবরণের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রাও বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনিসেফের ইন্ট্যানজিয়েবল কালচারাল হেরিটেজের মর্যাদা পেয়েছে। ছায়ানটের বর্ষবরণ আর চারুকলার শোভাযাত্রা মিলে পয়লা বৈশাখে উৎসবমুখর হয় রাজধানী। আর গ্রামে গ্রামে চলে বৈশাখী মেলা।
ষাটের দশকে যেমন অন্ধকার সময় এসেছিল আমাদের আকাশে, এখন আবার তেমন আঁধারে ছেয়ে গেছে বাংলার আকাশ। সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর ব্যবস্থায় জঙ্গিদের ভয়ংকর থাবা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। তবে মৌলবাদীদের আস্ফালন এখনো আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন তা বারবার হোঁচট খায় মৌলবাদীদের অপতৎপরতায়। গোপন জঙ্গিবাদ আর প্রকাশ্য মৌলবাদের কালো হাত থেকে জাতিকে বাঁচাতে চাই সমন্বিত প্রতিরোধ। সেটা হতে হবে প্রথমত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর ব্যবস্থায়। এছাড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিরোধটাও জরুরি।
সাংস্কৃতিক প্রতিরোধটাই আসলে সবার আগে হওয়া উচিত। আমাদের মুক্তিসংগ্রামে রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সুনির্দিষ্ট করেছিল সাংস্কৃতিক গণজাগরণ। এখন আবার আমাদের সংস্কৃতি রক্ষায়, জাতি রক্ষায় সাংস্কৃতিক জাগরণ দরকার। জঙ্গিরা আমাদের তরুণদের, নারীদের, এমনকি শিশুদেরও মগজ ধোলাই করে মাঠে নামিয়ে দিচ্ছে। ইসলামের নামে হত্যা করে, সন্ত্রাস করে, আত্মহত্যা করে তারা নিজেদের পরকাল নিশ্চিত করতে চাইছে। তাই এই মগজ ধোলাইয়ের বিপদ থেকে সবাইকে রক্ষা করতে চাই পাল্টা মগজ পরিষ্কারের কৌশল। মৃত্যু নয়, জীবনই যে আনন্দময়; ইসলাম ধর্মও যে জীবনের জয়গান গায়, তা বোঝাতে হবে সবাইকে।
গোপন জঙ্গিবাদের চেয়ে কম বিপজ্জনক নয় প্রকাশ্য মৌলবাদীরা। মৌলবাদ হলো জঙ্গিবাদের প্রথম ধাপ। জঙ্গিবাদের বিপদ থেকে নিস্তার পেতে হলে আগে রুখতেই হবে।
ধর্ম যেকোনো রাষ্ট্রের ভিত্তি হতে পারে না, ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা তা বুঝেছি। ১৯৪৭ সালের ভুল শুধরাতে ২৩ বছর লেগেছে। একাত্তরে আমাদের অর্জন একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্রে সবাই যার যার ধর্ম পালন করবে নির্বিঘ্নে বাংলাদেশ শুধু মুসলমানদের নয়; সব ধর্মের, সব মানুষের। বাংলাদেশ বাঙালির, চাকমার, গারোর; বাংলাদেশ গজলের, ভাটিয়ালির, বাউলের। বাংলাদেশ বর্ষবরণের, বাংলাদেশ মঙ্গল শোভাযাত্রার। কিন্তু রাষ্ট্রের এই মৌলিক ভিত্তি ধরেই টান দিতে চাইছে মৌলবাদীরা। অতীতে তাদের সঙ্গে লড়াই করেই জিততে হয়েছে, আপস করে নয়। আবারও তাদের লড়াই করেই জিততে হবে। সেই লড়াইটা শুরু হোক ছায়ানটের বর্ষবরণে, চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায়।
সেই লড়াইয়ের শুরুটা হোক নতুন বছরেই।
প্রভাষ আমিন: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন