মিডিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে বিবিসি’র বিশেষ প্রতিবেদনে যা বলা হলো

ছয় মাস আগে ঢাকায় একটি রাজনৈতিক সমাবেশে পেশাগত দায়িত্ব পালনে গিয়েছিলেন একটি জাতীয় পত্রিকার সাংবাদিক রাফসান জানি। ঢাকার কাকরাইলের কাছে একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। রাফসান জানি তখন কিছুটা দূর থেকে সেই সংঘর্ষের ছবি তুলতে শুরু করেন। হঠাৎ দেখলাম যারা পুলিশকে মারছিলো তাদেরই একজন আমার দিকে তেড়ে আসলো। এই তুই আমাদের ছবি তুলছিস কেন? এই কথা বলেই সে আমার গলায় ঝোলানো আইডি কার্ড ছিঁড়ে ফেলে। এরপর মারধর শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে চতুর্দিক থেকে সবাই এসে মারা শুরু করেন বলে জানান রাফসান।

সেদিন হামলায় সারা শরীরে আঘাত পান রাফসান। তার ভাষায়, বেঁচে ফিরবেন এমন আশাও হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। পিঠের মধ্যে যে কী পরিমাণ আঘাত হয়েছে! এটা অগনিত। পুরো পিঠ কালো হয়ে গিয়েছিলো। মাথা, বুক সবখানে আঘাত। আমার পরিচয় বারবার দিচ্ছিলাম। কিন্তু কেউ শুনছিলো না। চারপাশে তাকিয়ে কোন আশ্রয়ও পাচ্ছিলাম না সে সময়। বেঁচে ফিরবো বলে সে সময় মনে হয়নি।

ঢাকায় সেই সাংবাদিক রাফসানের যে অভিজ্ঞতা, সেটা অবশ্য বাংলাদেশে নতুন নয়। দেশটিতে গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগও বেশ পুরনো।

এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের হয়রানি, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও আইনগত নানা প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে গণমাধ্যমের প্রবেশ কিংবা তথ্য সংগ্রহে নানারকম বিধিনিষেধ। এসবের মধ্যেই শুক্রবার দেশটিতে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম’ দিবস। বাংলাদেশে মুক্ত গণমাধ্যম কতদূর? এদেশে এখন গণমাধ্যমের উপর ঠিক কী ধরণের চাপ দেখা যাচ্ছে?

‘এজেন্সি থেকে ফোন আসে’ : বাংলাদেশে সাংবাদিকদের নির্যাতন ও হুমকি থেকে শুরু করে খুনের ঘটনাও আছে। তবে এ ধরণের পরিস্থিতি যে সবখানে বা সকলেই এর মুখোমুখি হচ্ছেন তেমনটা অবশ্য নয়। কিন্তু যেখানে এ পরিস্থিতি নেই, সেখানে আবার আছে তথ্য পাওয়া কিংবা সংগ্রহের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি দপ্তরগুলোতে এমন প্রতিবন্ধকতার কথা জানাচ্ছেন সাংবাদিকরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক, পরিকল্পনা কমিশনের মতো সরকারি দপ্তরগুলোতে সাংবাদিকদের প্রবেশে কখনও নিষেধাজ্ঞা, কখনও কড়াকড়ি বেশ আলোচিত হয়েছে। এর সমালোচনাও করেছে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনগুলো।

বাংলাদেশে বাণিজ্য-অর্থনীতি বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টাস ফোরামের জেনারেল সেক্রেটারি আবুল কাশেম বলেন, এসব ঘটনায় সাংবাদিকরা তথ্য সংগ্রহে বাধার মুখে পড়ছেন। এখন পর্যন্ত যেসব জায়গায় সাংবাদিকদের ঢুকতে বাধা আসছে, সেখানে কোথাও কিন্তু ভুল নিউজের কারণে এটা হয়নি। বরং তারা একটা জিনিস গোপন রাখতে চেয়েছে, সেটা সাংবাদিকরা প্রকাশ করে দিয়েছে। সে কারণে সাংবাদিকদের অ্যাকসেসটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন কাশেম।

নানামুখী কারণে সরকার বা রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট কোন কোন তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে চাপের মুখোমুখি হচ্ছেন অনেক সাংবাদিক। তবে ইদানিং সরাসরি সরকার সংশ্লিষ্ট নয় এমন চাপ আসছে।

বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দিক থেকেও এই চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী গ্রুপ আছে যারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকায় ঋণ খেলাপি। কিংবা নানা অনিয়মের মাধ্যমে অনেক ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা বের করে নিয়ে যাচ্ছে। এসব ব্যবসায়ী গোষ্ঠী নিয়ে সংবাদ করতে চাইলে নানা ধরণের চাপ আসে বলে সাংবাদিকরা অভিযোগ করছেন। আপনি যখন সংবাদের নিয়ম অনুযায়ী ঐ ব্যবসায়ীর মন্তব্য নেয়ার জন্য যোগাযোগ করবেন, তখন দুই/তিন মিনিটের মধ্যেই বিভিন্ন এজেন্সি থেকে ফোন চলে আসে। সংবাদপত্র অফিসের সম্পাদক বা শীর্ষ পর্যায়ে ফোন করে বলা হয় যে রিপোর্টটা করা যাবে না। এ ধরণের প্রেশার এখন আছে এবং এটা দিনদিন বাড়ছে বলে জানান কাশেম।

র‍্যাংকিং- এ নিচের দিকে : গত বছর আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যমগুলোর পরিস্থিতি নিয়ে একটি মুক্তগণমাধ্যক সূচক তৈরি করে। যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান হয় ১৬৩তম যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ম। পাকিস্তান, ভারত তো বটেই এমনকি আফগানিস্তানেরও নিচে অবস্থান হয় বাংলাদেশের।

এছাড়া তথ্য ও মতপ্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিনও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে রেখেছে ‘সংকটজনক’ ক্যাটাগরিতে।

কিন্তু এমন অবস্থা কেন তৈরি হলো?: আর্টিকেল নাইনটিন-এর দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিতার সংকট তৈরি হয়েছে এবং বিষয়টির রাজনৈতিক চেহারা দেয়া হচ্ছে। আমরা অপরাধকে অপরাধ হিসেবে দেখতে পারছি না। এই যে সামগ্রিকভাবে অসহিষ্ণুতা তৈরি হয়েছে, যেটা আসলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। তাতে আরো রসদ জুগিয়েছে নিবর্তনমূলক বিভিন্ন আইন।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের যে অবনমন তার পেছনে নিবর্তনমূলক আইনগুলো ভূমিকা রেখেছে বলেই মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা।

তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত দাবি করছেন, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ‘সরকার হস্তক্ষেপ করছে না’। তাহলে র‍্যাংকিং- এ কেন এতো অবনমন? এমন প্রশ্নে র‍্যাংকিং-এর ‘বিভিন্ন অসঙ্গতির’ কথা তুলে ধরেছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী।

তার দাবি, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের অবস্থা নিয়ে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস- এর প্রতিবেদনে ‘পদ্ধতিগত’ এবং ‘তথ্যগত’ ভুল আছে। তারা এক জায়গায় ছয় জনকে ডিটেইন করার কথা উল্লেখ করেছে। পরে আমরা খোঁজ নিয়ে দেখলাম পুরোটাই ভুল। তখন আমরা চিঠি দিলাম। তারা সেটা গ্রহণ করেছে। এবং সে তথ্য সরিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সরিয়ে ফেলার পরও কিন্তু তারা র‍্যাংকিংয়ে এর রিফ্লেকশন দেয়নি বলে জানান তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত।

মামলার কী হবে?: বাংলাদেশে বহুল বির্তর্কিত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন পরিবর্তন করে ২০২৩ সালে নতুন একটি আইন করা হয়। যার নাম দেয়া হয় সাইবার নিরাপত্তা আইন। কিন্তু এই আইনেও সাজা এবং জামিন অযোগ্য ধারা কমানোসহ বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হলেও সেটা যথেষ্ট নয় বলেই মত মানবাধিকার সংগঠনগুলোর।

এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে আইনে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও জব্দ এবং মানহানি, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিসহ বিভিন্ন ধারার অপব্যবহারের সুযোগ থেকে যাওয়া। তবে নতুন আইন হলেও আগের ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে দায়ের হওয়া সাত হাজারেরও বেশি মামলা আছে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের বিরুদ্ধে। যেসব মামলা এখনও চলমান। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় সমালোচনাও করেছেন মানবাধিকার সংগঠন ও সাংবাদিক নেতারা।

তথ্য প্রতিমন্ত্রী জানান, এই মামলার ব্যাপারে করনীয় ঠিক করতে উদ্যোগ নেবেন তিনি। এখন তো সাইবার নিরাপত্তা আইন চলছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নেই। কিন্তু আগের মামলাগুলো যদি পুরনো আইনেই চলে তাহলে এটা নিয়ে আমি আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাই। এখানে কথা বলে একটা সমাধানের চেষ্টা করবো।

তবে তথ্য প্রতিমন্ত্রী অবশ্য আইনের মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাধা দেয়ার অভিযোগ নাকচ করে দিচ্ছেন। তার ভাষায় সাইবার নিরাপত্তা আইনে যে ব্যবস্থা আছে সেটা ‘অপতথ্য’ রোধে।

তিনি দাবি করেন, সংবাদমাধ্যম প্রতিদিন যে সাংবাদিকতা করছে সেটির ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রযোজ্য নয়। ‘রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার’ ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ধরুণ এমন কোন একটা নেগোসিয়েশন চলছে কোন একটা দেশের সঙ্গে যেটা প্রকাশ হলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো। ঐখানে যদি আপনি সাংবাদিকতার নামে, ব্রেকিং নিউজের নামে এমন কিছু করে ফেলেন বা প্রকাশ করেত চান। সেখানে যদি পুলিশের কাছে তথ্য আসে, এটা বাইরে যাবার আগেই সে (পুলিশ) এটাকে আটকাতে পারবে, তখন তো সে এটা করবে। রাষ্ট্রের স্বার্থে করতে হবে। এটা গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না। এটা রাষ্ট্রের স্বার্থ।

এছাড়া সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে যে কারো বিরুদ্ধে কোন রিপোর্ট হলে সেটা মানহানি নয় বলেও উল্লেখ করেন মোহাম্মদ আলী আরাফাত। বলেন, মানহানি তখনই হয় যখন অপপ্রচার বা অপতথ্যের মাধ্যমে কাউকে খাটো করা হয়।

‘তথ্য পেলে গুজব কমে’: বাংলাদেশে কোন কোন সরকারি দপ্তরে সাংবাদিকদের তথ্যপ্রাপ্তি কিংবা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি এখন বেশ আলোচিত হচ্ছে। এছাড়া তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চেয়ে উল্টো হয়রানির মুখে সাংবাদিকরা পড়ছেন এমন অভিযোগও এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। তাছাড়া তথ্য অধিকার আইনে তথ্য পেতে প্রায় ৩০ দিন অপেক্ষা করার বিষয়েও আপত্তি তুলেছেন গণমাধ্যমকর্মীরা।

তথ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, এসব বিষয় নিয়ে কাজ করবে তার দপ্তর। আমাদের এখানে প্রবণতা তৈরি হয়েছে, প্রশাসনে যারা আছেন, ইনফরমেশন চাইলেই তারা অনেকে একটু অফেন্ডেড হয়ে যান। এখানে যে অফেন্ডেড হওয়ার কিছু নেই সেই সংস্কৃতিটা তৈরি করতে হবে। তথ্য তো আমার প্রোপার্টি না, এটা জনগনের প্রোপার্টি। এটা দেয়া আমার দায়িত্ব। তথ্য পেলে তখন গুজবের সুযোগ কমে যায়। এখানে আমরা এখন দপ্তরগুলোতে কিছু কাজ করবো।

প্রতিমন্ত্রী বলছেন. তথ্যের প্রবাহ এবং মুক্ত গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে সরকার কোন বাধার সৃষ্টি করছে না। এছাড়া আইনের অপপ্রয়োগ যেন না হয়, সে বিষয়েও সতর্ক আছে।

যদিও এর আগেও বিভিন্ন সময় সরকারের বিভিন্ন পক্ষ থেকে একইরকম আশ্বাস দেয়ার নজীর আছে। যদিও সেসময় সংবাদ প্রচারের কারণে গণমাধ্যম বন্ধ কিংবা অনলাইনে নিউজ পোর্টাল বা কন্টেন্ট ব্লক করার উদাহরণও। আছে মানহানিসহ বিভিন্ন মামলায় হয়রানি ও গ্রেপ্তারের উদাহারণ।

ফলে সরকারের পক্ষ থেকে মতপ্রকাশ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় কোন চাপ নেই বলা হলেও অতীত অভিজ্ঞতায় সেটার বাস্তবতা কতটা থাকবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। সূত্র: বিবিসি।