আইএসপি লাইসেন্স ফি ১ লাখের পরিবর্তে ২৫ লাখ টাকা

দেশে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের (আইএসপি) এক লাখ টাকার লাইসেন্স ফি ২৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এ জন্য একটি প্রস্তাবনা অনুমোদনে ইতোমধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে পাঠিয়েছে সংস্থাটি। নতুন প্রস্তাবনায় লাইসেন্স ফি ২৫ লাখ এবং নবায়ন ফি ৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই এর আগে ফি ছিল এক লাখ টাকা করে। এ ছাড়া বর্তমানে অপারেশনে থাকা ন্যাশনওয়াইড, সেন্ট্রাল ও জোনাল আইএসপির তিন ক্যাটাগরিতেও আনা হচ্ছে পরিবর্তন। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাতেই লাইসেন্স ও নবায়ন ফি বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানা গেছে বিটিআরসি সূত্রে। এদিকে ফি বৃদ্ধির ফলে গ্রাহক পর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেছে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং বিটিআরসি সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়ের উপস্থিতিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের কার্যক্রম পর্যালোচনা সংক্রান্ত একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় আইএসপি লাইসেন্সের ফি বৃদ্ধি এবং প্রতিশ্রুত সেবা নিশ্চিত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সভার সিদ্ধান্তে বলা হয়, অনতিবিলম্বে আইএসপি লাইসেন্স সংশ্লিষ্ট ফিগুলো বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আইএসপি লাইসেন্স নবায়নের সময় লাইসেন্সের শর্তানুযায়ী সেবা প্রদান করা হচ্ছে কিনাÑ তা নিশ্চিত হওয়ার পর লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে। অধিক সংখ্যক লাইসেন্স প্রদান না করে প্রয়োজনীয়তার নিরিখে লাইসেন্স প্রদান করতে হবে। একই সঙ্গে যেসব আইএসপি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের শর্তানুযায়ী কার্যক্রম চালু করেনি তাদের আইএসপি লাইসেন্স বাতিল করতে হবে।

এই সভার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ২৯ মে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বিটিআরসিকে চিঠি দেয়। চিঠিতে বলা হয়, আইএসপির জন্য নতুন কোনো গাইডলাইন প্রণয়ন না করে বিটিআরসির বর্তমান গাইডলাইনেই লাইসেন্স ফি বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রেরণ করার।
১৫ ফেব্রুয়ারি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে অনুষ্ঠিত সভার নির্দেশনার বিষয়ে বিটিআরসিতে ২৯ জুন অনুষ্ঠিত বিশেষ সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বিটিআরসির পক্ষ থেকে বলা হয়, আইএসপি লাইসেন্স দুটি ক্যাটাগরিতে ইস্যু করা হবে। এর একটি ন্যাশনওয়াইড এবং অন্যটি জোনাল। তবে ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বিশেষ সভায় দুটির পরিবর্তে তিনটি ক্যাটাগরি করার সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। এগুলো হচ্ছেÑ ন্যাশনওয়াইড, আরবান ও রুরাল। ন্যাশনওয়াইড লাইসেন্সধারী আইএসপিগুলো দেশের যে কোনো অঞ্চলে সেবা প্রদান করতে পারবে। আরবান আইএসপি লাইসেন্সধারীরা সব মেট্রোপলিটান এলাকা/সকল ডিভিশনাল হেড কোয়ার্টার/সব জেলা সদর এলাকায়। আর রুরাল লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলো জেলা সদরের বাইরে যে কোনো উপজেলা/থানায় সেবা প্রদান করতে পারবে।

এ জন্য ন্যাশনওয়াইড আইএসপি লাইসেন্সের ফি পূর্বের এক লাখ টাকার পরিবর্তে নতুন করে নির্ধারণ করা হয় ২৫ লাখ টাকা। বার্ষিক নবায়ন ফি এক লাখ টাকার স্থলে পাঁচ লাখ, প্রতিটি আবেদনের জন্য ৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া কমিশনের সঙ্গে রেভিনিউ শেয়ারিং এক শতাংশ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের (এসওএফ) জন্য ১ শতাংশ রেভিনিউ শেয়ারিং নির্ধারণ করা হয়। আরবান আইএসপি লাইসেন্সের জন্য লাইসেন্স ফি এক লাখের বিপরীতে ১৫ লাখ, বার্ষিক নবায়ন ফি এক লাখের পরিবর্তে ৩ লাখ, আবেদন ফি ৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া রেভিনিউ শেয়ারিং ও সামাজিক দায়বদ্ধতা ফান্ডের জন্য একই রকম হার নির্ধারণ করা হয়েছে। রুরাল আইএসপির জন্য লাইসেন্স ফি এক লাখ টাকা, বার্ষিক নবায়ন ফি ২৫ হাজার এবং আবেদন ফি ৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া এক শতাংশ করে রেভিনিউ শেয়ারিং ও সামাজিক দায়বাদ্ধতা তহবিলে দিতে হবে।

কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বর্তমানে প্রচলিত লাইসেন্সিং পদ্ধতির আওতায় যেসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন জোনের জন্য লাইসেন্স গ্রহণ করে আইএসপি সেবা প্রদান করে আসছে, তাদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বেই নতুন লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে হবে। অন্যথায় মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববর্তী লাইসেন্স কার্যকারিতা হারাবে।

কমিশনের সভায় সাইবার ক্যাফেসহ আইএসপির ক্ষেত্রে বর্তমান প্রচলিত লাইসেন্সিংয়ের পরিবর্তে রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট ইস্যু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রচলিত ক্যাটাগরিভিত্তিক লাইসেন্স বিলুপ্ত হবে অর্থাৎ পূর্বের মতো এ, বি, বা সি এমন কোনো ক্যাটাগরি থাকবে না। এ ছাড়া এই রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট থানা, পৌরসভা/উপজেলাভিত্তিক কমিশন থেকে ইস্যু করা হবে। সাইবার ক্যাফে ইন্টারনেট সার্ভিসসহ রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেটের জন্য রেজিস্ট্রেশন ফি ২৫ হাজার টাকা। বার্ষিক অডিট গ্রস রেভিনিউ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের জন্য এক শতাংশ করে নির্ধারণের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

কমিশন সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে প্রচলিত দুটি ক্যাটাগরিতে আইএসপি লাইসেন্স সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে ন্যাশনওয়াইড, জোনাল (সেন্ট্রাল জোন) এবং জোনাল (সাউথ-ইস্ট, নর্থ-ইস্ট, সাউথ-ওয়েস্ট, নর্থ-ওয়েস্ট) জোন।

চলতি বছর কমিশনের তৃতীয় বিশেষ সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত বিদ্যমান লাইসেন্সের গাইডলাইনে পরিবর্তন/সংযোজন/পরিবর্ধন করে স্বয়ংসম্পূর্ণ আইএসপি লাইসেন্সিং গাইডলাইন অনুমোদনের জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে প্রেরণ করা হয়েছে।

বিটিআরসির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে এ খাত হুমকির মুখে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন আইএসপিএবির সভাপতি এমএ হাকিম। তিনি বলেন, নতুন করে কেউ লাইসেন্স নিলে তাদের কাছ থেকে লাইসেন্স ফি আদায় করা যায়। কিন্তু যারা ইতোমধ্যে লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছে তাদের কাছ থেকে আবার কেন ফি আদায় করতে হবে? এটি করলে প্রকারান্তরে গ্রাহকদের ওপর চাপ পড়বে জানিয়ে তিনি বলেন, এতে গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং অবৈধ ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা উৎসাহিত হবেন।

ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক বলেন, আগে যেখানে এক লাখ টাকা ফি নেওয়া হতো, সেখানে ২৫ লাখ টাকা নেওয়া অযৌক্তিক। আবার সবার জন্য নতুন করে রেজিস্ট্রেশন করার সিদ্ধান্তটিও উদ্ভট বলে তিনি মন্তব্য করেন। এমদাদুল হক বলেন, যারা ইতোমধ্যে লাইসেন্স নিয়েছেন, তারা কেন আবার রেজিস্ট্রেশন করবেন? এ সিদ্ধান্ত ইন্টারনেট ব্যবসা ও ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করবে।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, সরকার একদিকে বলছে সবার কাছে সব এলাকায় কম মূল্যে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেবে। অন্যদিকে নানারকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তা হলে কীভাবে সম্ভব হবে? বর্তমানে দেশে ৫৯০টির মতো আইএসপি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স নিয়ে কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। ন্যাশনওয়াইড আইএসপির ১১৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কার্যক্রম চালাচ্ছে ৭৫টি, জোনাল দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া কিছু বড় বড় প্রতিষ্ঠান শুধু তাদের নিজস্ব সেবার জন্য কার্যক্রম পরিচালিত করছে।