আন্তর্জাতিক ডেস্ক

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রথম বিচার দাবি

১৯৭৫ সালে সপরিবারে হত্যা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জাতি ছিল স্তম্ভিত, দিক নির্দেশনাহীন। দলের কিছু ঘাতক অনেকেই ঘাতকদের সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে ব্যস্ত। বাকস্বাধীনতা ছিল না দেশে। দেশের বাইরেও কেউ এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারেননি। বাঙালিদের কাছে জাতির জনকের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এমন এক অবিশ্বাস্য ও নারকীয় ঘটনা ছিল যে শোকে মুহ্যমান জাতি একেবারে দিশাহারা হয়ে পড়ে। এর বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করার মতো শক্তি সেই মুহূর্তে ছিল না।

কিন্তু থেমে ছিলেন না জাতির জনকের সম্মানিত দুই কন্যা। তাঁরা বিশ্বমানবতার কাছে পিতৃহত্যার বিচার চেয়েছিলেন। বিচার চেয়েছিলেন ইতিহাসের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে বিশ্বমানবতার কাছে প্রথম আবেদন রাখা হয় ১৯৭৯ সালের ১০ মে। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠা কন্যা শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে বিশ্বমানবতার কাছে এই আরজি পেশ করেছিলেন তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা।১০ মে ১৯৭৯, সেদিন স্টকহোমে অনুষ্ঠিত হয় সর্বইউরোপীয় বাকশালের এক বিশাল সম্মেলন।

সে সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠা কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদানের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তখন ভারত থেকে সুদূর সুইডেনে গিয়ে সম্মেলনে যোগ দেওয়া উনার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সর্ব ইউরোপীয় নেতারা শেখ হাসিনার প্রতিনিধিত্ব করতে শেখ রেহানাকে অনুরোধ করেন। দিল্লি থেকে ফোনে শেখ হাসিনাও বোন শেখ রেহানাকে বলেন সম্মেলনে যোগদান করতে। অনুষ্ঠানে কী বলতে হবে সে বিষয়ে তিনি টেলিফোনে ছোট বোনকে নির্দেশনা দেন। শেখ রেহানা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সুইডেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত আবদুর রাজ্জাকের আন্তরিক চেষ্টায় এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি সুলতান মাহমুদ শরীফ, স্পেনে সাবেক রাষ্ট্রদূত শেলী জামান ও সেলিমুজ্জামান।

সম্মেলনের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁর পাঠানো লেখা পাঠ করেন শেখ রেহানা। বড় বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে বক্তব্যও রাখেন তিনি। এটাই ছিল কোনো রাজনৈতিক সমাবেশে শেখ রেহানার প্রথম বক্তব্য রাখা। আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তিনিই সর্বপ্রথম পঁচাত্তরের কলঙ্কজনক ও অমানবিক হত্যাকাণ্ডের বিচারের জোর দাবি তোলেন।

সেদিন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, জাতিসংঘের মহাসচিব, জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কমিশনের চেয়ারম্যান, আমেরিকার কংগ্রেসের হিউম্যান রাইটস কমিটির চেয়ারম্যান, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের প্রধানদের কাছে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচারের প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি।

পঁচাত্তরের পৈশাচিক বর্ণনা দিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে শেখ রেহানার আবেগঘন বক্তব্য সে অনুষ্ঠানে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।সম্মেলনের হল ভর্তি প্রবাসী বাঙালি নারী-পুরুষ এবং বিদেশি রাজনীতিবিদ, পার্লামেন্ট সদস্য ও মিডিয়ার প্রতিনিধিরা নীরবে মনযোগ সহকারে তাঁর বক্তব্য শোনেন।১৫ই আগস্টের মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির বিচার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা সব সময় ভাবতেন। এ ব্যাপারে তিনি টেলিফোনে দিল্লিতে বড় বোনের সঙ্গে পরামর্শ করেন। শেখ হাসিনার পরামর্শ অনুযায়ী ১৯৮০ সালের ২০ জানুয়ারি সেন্ট্রাল লন্ডনের কনওয়ে হলে সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ড. সেলিমকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যাদের সম্মতিতে ড. শফিক সিদ্দিক সভাপতি পদে প্রস্তাব করেন স্যার টমাস উইলিয়ামসের নাম, যা সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যা সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য বিশ্বখ্যাত আইনজ্ঞদের নিয়ে ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৮০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনের ‘হাউস অব কমন্স’-এর নিকটবর্তী কুন্দুন রেস্টুরেন্টে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি এমপি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কমিশন গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। কমিশনের চেয়ারম্যান হলেন স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি এমপি, সদস্যরা হলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী বিখ্যাত আইরিশ আইনজীবী মি সন ম্যাকব্রাইড, লেবার পার্টির আইনবিষয়ক মুখপাত্র জেফ্রি টমাস কিউসি এমপি এবং সলিসিটার মি অব্রে রোজ।

মি অব্রে রোজকে কমিশনের সেক্রেটারির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত কমিশনের সদস্যরা ছাড়াও কনজারভেটিভ পার্টির আইনবিষয়ক মুখপাত্র ও এমপি, লিবারেল পার্টির আইনবিষয়ক মুখপাত্র ও এমপিসহ বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এবং ড. কামাল হোসেনসহ বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাঙালি উপস্থিত ছিলেন।

১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের বিচারের পক্ষে বিশ্ববিবেক জাগ্রত করতে এই তদন্ত কমিশন গঠন ছিল শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নিরন্তর চেষ্টার ফসল।তখন দেশে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ প্রায় নিষিদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার স্বদেশ ফিরে আসার পথে সামরিক জান্তা জেনারেল জিয়া তৈরি করেন নিষেধের বেড়াজাল। ওই সময় অতল অন্ধকারের ঘূর্ণাবর্তে ঘুরপাকরত দিকনির্দেশহীন, কাণ্ডারিবিহীন জাতিকে নেতৃত্বের শূন্যতা থেকে রক্ষা করার জন্য বঙ্গবন্ধুপ্রেমী কোটি কোটি মানুষের দৃষ্টিতে একমাত্র আশার প্রদীপ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সে লক্ষ্যেই ১৯৮১ সালের ১৭ মে দীর্ঘ প্রায় ছয় বছরের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে স্বদেশভূমিতে ফিরে আসেন।

১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসীন করেন শেখ হাসিনা। তখন ‘ইনডেমনিটি’ অধ্যাদেশ বাতিল করার জন্য তাঁর সরকার আদালতের শরণাপণ্ন হয়। আদালত অধ্যাদেশটি সংবিধানের পরিপন্থী বলে রায় দেয়। তারপর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি’ অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়।

অতঃপর ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে হত্যাকারীদের বিচার অনুষ্ঠান না করে দেশের প্রচলিত আইনে স্বাভাবিক পন্থায় বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালের ১২ মার্চ বিচারকার্য শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বিচারক কাজী গোলাম রসুল মামলার রায় ঘোষণা করেন। ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়ে শেখ হাসিনা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পর ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর ওই আপিলের তথা মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি পাঁচ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। এ ইতিহাস সবারই জানা। সেই দিন, ১৯৭৯ সালের১০ মে এই দিনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে পরিবারের সদস্যরা আবেদন জানিয়েছিলেন বিশ্ববিবেক ও বিশ্বমানবতার জাতির কাছে।

আজ দেশ ও জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। এই কলঙ্কমোচনের প্রথম সোপান রচিত হয়েছিল আজকের এই দিনে সুদূর সুইডেনে। আর এই সোপান রচনায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা।