ইন্দোনেশিয়ার বালি থেকে মুসা ইব্রাহীমের যাত্রা শুরু

ঢাকায় তখন সোমবার রাত ১টা। আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে আকাশভ্রমণ দেরি হবে। কর্তৃপক্ষ নিজেই ভ্রমণসূচি দুঘণ্টা পিছিয়েছে। সে মোতাবেক হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেছি গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। সেদিন দিনের বেলা নাভিশ্বাস ওঠা গরম ছিল। কিন্তু বিকেল হতেই শুনি উপকূলে ‘মোরা’ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ এরইমধ্যে উপকূল এলাকায় সাত নম্বর বিপদ সংকেত ঘোষণা করেছে। খবরটা শুনেই মনের মধ্যে একটা আশঙ্কা ঘুরপাক খেতে শুরু করল। না জানি উপকূলের লোকজন কীভাবে এ ঝড়কে মোকাবিলা করবে! তাদের হাতে প্রস্তুতি নেওয়ার সময় একেবারেই কম। তারপরও যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার একটা সুনাম আছে, হয়ত তেমন কোনো বড় দুর্যোগের কারণ হবে না এ ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’– মনকে সান্ত্বনা দিলাম।

সমুদ্র উপকূল এলাকায় তখন বড় বড় ঢেউ পাড়ে এসে আঘাত হানছে। অন্যদিকে ঢাকার আকাশে মেঘ। মেঘ দেখে আনন্দিত হওয়ার কথা। কিন্তু কেউই তা হতে পারছি না ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার কথা শুনে। পাল্লা দিয়ে ভ্যাপসা গরমের মাত্রাও যেন বেড়ে চলেছে প্রতি মুহূর্তে। ফলে ঢাকার মধ্যে যে কোনো গন্তব্যে যাত্রাপথে বাহনের ভেতর বসে থেকেও ঘামছি। এদিন ছিল দ্বিতীয় রোজা। রোজা রেখেই প্রস্তুতি এগিয়ে নিয়েছি অভিযানের– নীলসাগর গ্রুপ মাউন্ট কার্সটেঞ্জ পিরামিড অভিযান এ দিনই (২৯ মে) শুরু হওয়ার অপেক্ষায়।

দিন চারেক আগেই অবশ্য নীলসাগর গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক আরমান হাবিব, পরিচালক (অর্থ) মাহাবুব আলম মানিক ও ব্যবসা উন্নয়ন ব্যবস্থাপক ওয়াজেদ ফিরোজ অভিযানের পতাকা তুলে দিয়েছিলেন। আর ২৯ মে সকালে ঘটল আরেক ঘটনা। ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা, ফার্স্ট সেক্রেটারি রাজেশ উইকে (পলিটিক্যাল টু) ও অন্যান্য কর্মকর্তাবৃন্দ ‘বাংলাদেশ-ভারত ফেন্ডশিপ এক্সপেডিশন টু মাউন্ট কার্সটেঞ্জ পিরামিড’- এর পতাকা তুলে দিলেন। এ সময়ে হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা তার পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণের গল্প শোনালেন। তাকে ২০১০ সালের ২৩শে মে আমাদের বাংলাদেশ থেকে প্রথম এভারেস্ট জয়ের গল্প শোনালাম। কথা প্রসঙ্গে যখন তিনি পর্বতারোহণের খুবই প্রয়োজনীয় মেডিকেল টার্ম– পালমোনারি এডিমা, সেরিব্রাল এডিমা, অ্যাক্লিম্যাটাইজেশন, হাইপোক্সিয়া বা ডেথ জোন ও এভারেস্টে সামিটে গেলে সময় জ্ঞান কেমন থাকতে হয়, সে নিয়ে যখন আলাপ করছিলেন, বুঝতে পারলাম তিনি পর্বতারোহণ সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান এখনও রাখেন। বেশ অনেক ভারতীয় পর্বতারোহী ও এভারেস্ট জয়ীর নামও তিনি সে সময় উল্লেখ করলেন।

এ সময় তিনি জানান, তিনি পায়ে হেঁটে নেপালের এভারেস্ট বেস ক্যাম্প অবধি গেছেন। শুনে ২০০৫ সালের দিকে নেপালে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ইমতিয়াজ আহমেদ’র কথা মনে পড়ে গেল। পর্বতারোহণকে তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার বা পর্বতারোহণকে উৎসাহ দেওয়ার এমন মানসিকতা সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে ইদানিংকালে বেশ লক্ষ করা যায়।

সবশেষে হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা আমাদেরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে মাউন্ট কার্সটেঞ্জ পিরামিডে সাফল্য কামনা করলেন। পুরো বিষয়ে আমাদের অশেষ সহযোগিতা করলেন ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কর্মকর্তা কল্যাণ কান্তি দাস। এরপর আমরা বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
বিমানবন্দরে পৌঁছার আগে এভারেস্ট একাডেমি’র রাফাহ উদ্দিন সিরাজী, আমরান হোসেন দুলু আর সারোয়ার হোসেন বুলবুল সর্বাত্মক সহযোগিতা করে গেল। মূলত তাদের সহায়তার কারণেই পুরো আয়োজনটা অনেক সহজ হয়ে গেল। আর নীলসাগর গ্রুপ অফিসে এক গল্পের ফাঁকে সিংহহৃদয় চেয়ারম্যান মো. আহসান হাবীব লেলিন যখন প্রায় ধমকের সুরে বললেন, আমি যেন আমার সেভেন সামিটের বাকি তিনটা পর্বত অভিযান সম্পন্ন করে ফেলি, তখন আমার মনে সম্ভাবনার এক অপূর্ব রোশনাই ফুটে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, দেশ ও আঞ্চলিক উন্নয়ন তো বটেই, নীলসাগর গ্রুপ পরিবারের সকল সদস্যদের জন্য চেয়ারম্যান মো. আহসান হাবীব যেভাবে চিন্তা করেন, একইভাবে চিন্তা করলে বাংলাদেশের মানুষ আরও বেশি মানবিক হতে পারত। শিল্পপতি হলেও তার চিন্তাচেতনায় নীলসাগর গ্রুপের একেবারে এন্ট্রি লেভেলের মানুষটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যতদিনই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, মনে হয়েছে যে এত বড় মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভণিতা একেবারেই করেন না। তার মধ্যে কখনও ‘কর্পোরেট ম্যানিয়া’ দেখিনি। বরং তার মধ্যে সবসময়ই আশা জাগানিয়া চিন্তা কাজ করে। ফলে আমিও তার কথায় আশান্বিত হয়ে ভারতের সত্যরূপ সিদ্ধান্ত ও নন্দিতা চন্দ্র শেখরের সঙ্গে দল বেঁধেছি। তার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তিনি নীলসাগর গ্রুপ মাউন্ট কার্সটেঞ্জ পিরামিড পর্বতাভিযানের স্পন্সর হলেন। বাংলাদেশ থেকে এভারেস্ট একাডেমি এবং ভারত থেকে কক্সঅ্যান্ডকিংস এ পর্বতাভিযানের আয়োজক হিসেবে থাকল।

বিমানবন্দরে পৌঁছে সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে যখন বোর্ডিং গেটে অপেক্ষা করছি, তখনও মালিন্দো এয়ারলাইন্সের প্লেনের দেখা নেই। আমার উদ্বেগের কথাটা জানিয়ে যতোই নিকট জনদের কাছে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েছি, কেউই সাড়া দেয়নি। ধরে নিয়েছি যে সারাদিনের ধকলে সবাই নিশ্চিত ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কাজেই অপেক্ষার প্রহর বাড়ল। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর হয়ে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে গিয়ে পৌঁছাতে হবে। সেখানে অভিযানের বাকি দু’অভিযাত্রী থাকবে। তাদের সঙ্গে গিয়ে যোগ দিতে হবে আমাকে। মনের ভেতর একটা হাহাকার কাজ করছে। এই বিদায়বেলায় সহধর্মিণী রিমি আর ছেলে রাইদ কাছে নেই!

এ পরিস্থিতিতে ১২টা ৫০ মিনিটে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও প্লেন এলো যাত্রা শুরুর মিনিট দশেক আগে। তখন বুঝতে পারলাম গন্তব্যের দিকে উড়তে আরও দেরি হবে। এক সময় প্লেনে ওঠার ঘোষণা এলো। নিজের আসন খুঁজে নিয়ে তাতে বসতেই পাশের দুযাত্রী গল্প শুরু করলেন। দুজনেই বাংলাদেশি। একজন মালয়েশিয়ায় গার্মেন্টসের ব্যবসা করেন। আরেক ছাত্র হলেও তিনিও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ছাত্র যিনি, তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি উত্তরা থেকে যাত্রাবাড়ী যাচ্ছেন, না কি আমাদের সঙ্গে একই প্লেনে কুয়ালালামপুর যাচ্ছেন! তার পরনে শার্ট, একটা রং জ্বলা জিন্সের প্যান্ট, পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল। তিনি কাঁধের ব্যাগটাকে যেভাবে পায়ের কাছে ফেলে রাখলেন, যেন এটা থোড়াই কেয়ার করার একটা বস্তু। সেটা আবার তিনি অন্যদের ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিলেন। দেখে বেশ মজাই লাগলো। ‘প্লেনযাত্রার ১০০০ সহজ নিয়ম : ১টি ফাও’ নামের বই তাকে দিয়ে অনায়াসেই লিখিয়ে নেওয়া যাবে। সবমিলিয়ে রাত প্রায় দুটার দিকে প্লেন ঢাকার মাটি ত্যাগ করল। প্লেনের মধ্যে দেয়া খাবারটুকু গোগ্রাসে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি।

প্রায় চার ঘণ্টা উড়ে প্লেন যখন কুয়ালালামপুরের কাছাকাছি এসেছে, এ সময়ে ঘুম ভেঙে গেল। সিট জানালার পাশে দেয়ার জন্য ঢাকায় এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তাটিকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম। ফলে প্লেনের জানালা দিয়ে কুয়ালালামপুরের সবকিছু পাখির চোখে দেখার সুযোগ হলো। লাখ লাখ পাম ট্রি দিয়ে সবুজে সেজেছে কুয়ালালামপুর। এর মধ্য দিয়েই সাজানো রাস্তায় যানবাহন ছুটছে গন্তব্যে। শহরবাসীর যাতায়াত সহজ করতে পথে খুব কমই ক্রসিং রয়েছে। বেশিরভাগ জায়গাতেই পথ বদলানোর জন্য ‘লুপ’ ব্যবহার করা হয়েছে। আছে ‘মেট্রোরেল’। উচ্চ ভোল্টের তিনটি বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনকে সমান্তরাল নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আবাসিক, অফিস পাড়া ও শিল্পকারখানাও দেখলাম আলাদা জায়গাতেই স্থাপন করা হয়েছে। সবকিছুতেই পরিকল্পনার ছাপ। আমাদের মতো জগাখিচুড়ি নয় মোটেই। এমনকি সাম্প্রতিক বাংলাদেশের ঢাকার এয়ারপোর্ট থেকে বনানীর দিকে সড়ক আধুনিকায়নের নামে যেমন দেশি গাছ সাবাড় করে বিদেশি বনসাই লাগানোর এক বিশ্রি আদিখ্যেতা শুরু হয়েছে, তেমন বিদেশপ্রীতি একেবারেই দেখলাম না এই কুয়ালালামপুরের ওপর দিয়ে উড়তে গিয়ে। এয়ারপোর্টটাও তেমনি বড়, সাজানো, গোছানো। আমার যে কানেক্টিং ফ্লাইট ছিল, তা এয়ারপোর্টে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্মীদের জিজ্ঞেস করতেই বলে দিল– আমাকে ট্রেনে করে এয়ারপোর্টের আরেকটা টার্মিনালে যেতে হবে। প্লেন থেকে নেমে এয়ারপোর্টে ঢুকে আরেকটা টার্মিনালে আমার কানেক্টিং ফ্লাইটের বহির্গমন বুথে পৌঁছাতে সর্বোচ্চ পনের মিনিট সময় ব্যয় হলো। দ্রুতই বোর্ডিং লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। সব প্রক্রিয়া শেষে একটা হাফ ছেড়ে ভারমুক্ত হলাম ঠিকই। কিন্তু এরপর আর একটু ফ্রেশ হওয়ার জন্য কোনো ওয়াশরুম খুঁজে পেলাম না। ২০১৪ সালে উত্তর আমেরিকার সর্বোচ্চ পবর্ত মাউন্ট ডেনালি জয়ের পর দেশে ফেরার সময় সকাল-বিকেলের হিসাব গুলিয়ে ফেলে প্লেন মিস করার পর থেকে প্লেনের সময় নিয়ে একটা ভীতি তৈরি হয়েছে– এই মনে হয় প্লেন আমাকে ফেলে চলে গেল! সেবার দেশে ফিরতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল। সেই থেকে প্লেনের ব্যাপারে একটা অস্বস্তি কাজ করে। আর ভিনদেশে গেলে এয়ারপোর্টের নানা পদের নিরাপত্তা তল্লাশি’র সময় মাঝে মধ্যেই বিরক্তি চরমপর্যায়ে চলে যায়। ভাষাগত ব্যবধান এর অন্যতম কারণ।

কুয়ালালামপুর থেকে বালি’র এই ফ্লাইটের যাত্রীদের প্রায় ৯৫ শতাংশই ভারতীয়। তারা বেরিয়ে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছে। পরিবারের ছেলে-বুড়ো সবাই, কেউই বাকি নেই। ব্যাপারটা ভালো লাগল।

প্লেনে উঠে বসলাম। কিন্তু কী এক কারণে ফের প্লেন ছাড়তে দেরি হবে। দেরি’র চক্কর দেখি কপাল থেকে সরছে না! এ চক্করের কোনো এক ফাঁকে ঘুমিয়ে পড়েছি। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর প্লেন ওড়ার জন্য যখন টারমার্কে গিয়ে থেমেছে, তখন ঘুম ভাঙল। প্লেনের মধ্যে আরেক দফা খাওয়া শেষে ফের ঘুম। বালি’র কাছাকাছি গিয়ে ঘুম থেকে জেগেছি। তখন প্লেনের অন বোর্ড এন্টারটেইনমেন্ট খুঁজে হলিউড অভিনেতা লিওনার্ডো ডি-ক্যাপ্রিও’র দি রেভন্যান্ট মুভি দেখতে বসে গেছি। আধাআধি দেখা হতেই পাইলটের ঘোষণা এলো– আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বালি এয়ারপোর্টে অবতরণ করতে যাচ্ছি। এ সময় বেরসিকের মতো মুভিও বন্ধ হয়ে গেল। আমরা ভারত মহাসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে বালি ডেনপাসার এয়ারপোর্টে নামলাম।

‘অন অ্যারাইভাল’ ভিসা নিয়ে ব্যাগ সংগ্রহ করে আগে এয়ারপোর্টের ইন্টারনেটের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছি। সত্যরূপ সিদ্ধান্তের সঙ্গে আলাপ করতে হবে যে সে কোথায় কোন হোটেলে উঠেছে, যেতে হবে কীভাবে, কতো সময় লাগবে, কতো খরচ হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্য জানালো যে তার এয়ারপোর্ট থেকে কুটাবেক্স বিচফ্রন্ট হোটেলে ট্যাক্সি করে যেতে এক লাখ চল্লিশ হাজার রুপি খরচ হয়েছে। সবকিছু জেনে নিয়ে চললাম কাস্টমসের দিকে। আনুষ্ঠানিকতা শেষে এয়ারপোর্টে ডলার ভাঙাতেই আরেক বিস্ময়। আমি মিলিয়নিয়ার হয়ে গেছি। এক ডলারে ১২ হাজার ৯শ ইন্দোনেশিয়ান রুপি পাওয়া যাচ্ছে। একশ ডলার ভাঙিয়ে পেলাম ১ দশমিক ২৯ মিলিয়ন রুপি। বুঝে নিয়েছি যে, এদের যেকোনো অংকের মুদ্রার শেষের তিনটি শুন্য না থাকলেও পারত। আর হিসাবে করে বুঝেছি, ইন্দোনেশিয়ান রুপি বাংলাদেশ টাকার চেয়ে প্রায় ছয় গুণ শক্তিশালী।

যাই হোক, মিলিয়নিয়ার হয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে ট্যাক্সির খোঁজ নিতে গিয়েই ধাক্কাটা এলো। প্রথমে একজন মেয়ে ট্যাক্সির খোঁজ নিয়ে হাজির। চায় দুই লাখ রুপি। আমি জানালাম, কোনোমতেই এক লাখ চল্লিশ হাজার রুপির বেশি নয়। তাতে সায় দিল না বালি ললনা। আমিও অন্য ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সঙ্গে আলাপ শুরু করেছি। এবার একেবারে চক্ষু চড়কগাছ। চায় তিন লাখ রুপি। বললাম, আমার বন্ধু গেছে এক লাখ চল্লিশ হাজার রুপিতে। তুমি তিন লাখ চাইছো কেন? সে এবার বললো, ওকে, দুই লাখ রুপি। রাস্তায় অনেক জ্যাম। সময় লাগতে পারে প্রায় বিশ-পঁচিশ মিনিট। সে কারণে দাম বেশি। তার কথা শুনে মনে মনে হাসি। ব্যাটাকে যদি কোনোমতে ঢাকায় নেওয়া যেতে পারে, তাহলে বুঝত যে জ্যাম কাকে বলে। মুখে হাসি রেখেই বললাম, কোনো সমস্যা নেই। আমি জ্যাম উপভোগ করতে জানি। এক লাখ চল্লিশ হাজারে হলে চলো। এবার বান্দা বুঝলো যে কাস্টমার চলে যাচ্ছে। সে এক লাফে এবার নিজেই দেড় লাখ রুপি’র প্রস্তাব দিল। দর কষাকষিতে একেবারে ‘গুলিস্তান স্টাইল’। আমি দেখলাম যে প্রস্তাবটা নেহায়েত খারাপ না। রাজি হয়ে গেলাম। পার্কিংয়ে যেতে যেতে জানতে চাইলাম যে, সে আসলেই ট্যাক্সি ড্রাইভার কি না? না কি ‘উবার’-এর মাধ্যমে সার্ভিস দেয়? কথা শুনে যে উবারকে শাপ-শাপান্ত করে ছাড়ল। নিজের পেশাদারি ট্যাক্সি ড্রাইভ্রিং পরিচয়পত্র দেখিয়ে বলল, উবার তাদের আয় রোজগারে অন্যতম প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুনে ইদানিং ঢাকার মানুষের উবার-উষ্মা’র কথা মনে পড়ে গেল।

ইন্দোনেশিয়ার লোকজনের মুখাবয়ব দেখে মনে হবে যেন এরা নিজ দেশের মানুষ। যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের সঙ্গে কথা বলতে গেছি, এটাই মনে হয়েছে। চেহারার মিল রয়েছে। কারো কারো চেহারায় অবশ্য মঙ্গোলিয়ান ছাপ রয়েছে। তাদের ট্র্যাডিশনাল ড্রেসগুলোও আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মতোই। পথে সে জানালো এয়ারপোর্ট থেকে আমার হোটেলের দূরত্ব চার কিলোমিটার। পথও সুন্দর। কথা প্রসঙ্গে জানলাম, তার বয়স মাত্র তেইশ। গত চার বছর ধরে সে ট্যাক্সি চালায়। কলেজের লেখাপড়া শেষে সে এ পেশায় এসেছে। আমি বালিতে কতদিন থাকব জিজ্ঞেস করায় তাকে জানালাম, বালিতে সর্বোচ্চ এক-দুদিন থাকব। এরপর যাবো পাপুয়া নিউগিনিতে। সেখানে কার্স্টটেঞ্জ পিরামিড পর্বত অভিযানে যাওয়ার জন্য এসেছি। জিজ্ঞেস করলাম, বালিতে পর্যটকদের জন্য কী কী করার আছে? বলল, এখানকার সমুদ্রকূলটাই সবচেয়ে বড় উপভোগের জায়গা। সেখানে সাঁতার কাটা যায়, নয়তো সার্ফিং করা যায়। কিংবা সিটি ট্যুর নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যেতে পারে বালি শহর। সবকিছুই খুবই উপভোগ্য। মনে মনে ভাবলাম, অভিযান শেষ করি আগে। তারপর দেখা যাক কী কী করা যায়! কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলেটা হোটেলে পৌঁছে দিল। তার নিজের বিজনেস কার্ড দিয়ে জানালো, যদি কোনো ট্যাক্সি সার্ভিসের প্রয়োজন হয়, যেনো তাকে জানাই। বললাম, ঠিক আছে, জানাব।

হোটেলে ঢুকেই লবিতে সত্যরূপের নাম বলাতে রিসিপশনিস্ট মেয়েটা কম্পিউটারে লগবুক চেক করে জানালো সে হোটেলেই আছে। রুমে ফোন করে কথা বললাম সত্য’র সঙ্গে। বললাম, লবিতে আছি, আসো। মিনিটখানেকের মধ্যেই এসে হাজির হলো সত্য। জড়িয়ে ধরলাম তাকে। প্রায় দেড় বছর পর দেখা। সর্বশেষ ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সাক্ষাত হয়েছিল। সে আমার আমন্ত্রণে নীলসাগর গ্রুপ স্কাই ম্যারাথনের ক্যাম্পেইনে যুক্ত হতে বাংলাদেশে এসেছিল। এরপর ফোনে বা ইন্টারনেটে যোগাযোগ হয়েছে। তার কাছ থেকেই এই কার্সটেঞ্জ পিরামিড অভিযানের খবর পেয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করছিল যে আমি যাব কি না? তখনও আমার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না, কারণ বেশ ভালো একটা স্পন্সর দরকার এ অভিযানে। এরপর যখন নীলসাগর গ্রুপের চেয়ারম্যান সিংহহৃদয় মো. আহসান হাবীব লেলিনের সঙ্গে দেখা হলো, তখন বুঝলাম একমাত্র সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাতেই সবকিছু ঘটছে। নয়ত সত্যরূপই বা কেন আমাকে এ অভিযানের কথা বলবে, আর আমি নীলসাগর গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আহসান হাবীব’ই বা কেন উচ্ছ্বসিত হয়ে এভাবে স্পন্সর করতে রাজি হবেন! আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম।

সত্য’র সঙ্গে কথা বলে রুম ঠিক করে নিয়ে উঠে পড়লাম। সেখানে ঢুকেই একটু ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে ফের ঘুমিয়ে পড়েছি।

লেখক : মুসা ইব্রাহীম, এভারেস্টজয়ী প্রথম বাংলাদেশি।