এক বাস চালক সংগ্রামী নারীর জীবনের গল্প
স্বামী শিবশঙ্কর গর্বের সঙ্গে বলছেন, ‘জানেন, পুজায় শঙ্খ বাজানোর প্রতিযোগিতায় আমাদের এলাকার সব পাড়ায় ও প্রথম হতো।’ সে দিন গিয়েছে! শাঁখ বাজানোর সুযোগ নেই। পুজায় নেই ছুটিও।
কারণ, পুজা মানেই বেশি ভিড়, বেশি উপার্জন। তাই দুই কন্যাকে নিয়ে ঠাকুর দেখাও নেই। পাড়ার মণ্ডপ থেকে বহুদূরে ‘ও’ তখন উঠে পড়েছেন মিনিবাসে। হাত স্টিয়ারিংয়ে। কলকাতার হাওড়া-নিমতা রুটের মিনিতে তিনি— প্রতিমা পোদ্দার চালক আর শিবশঙ্কর কন্ডাক্টর। খবর এবেলার।
প্রতিদিন ভোর ৩টা ২০ মিনিটে নিয়ম করে ওঠেন নিমতা-হাওড়া ভোরের মিনিবাসের চালক-কন্ডাক্টর জুটি! দু’বার হাওড়া-নিমতা যাতায়াতের পরে শ্যামাপ্রসাদ নগরের একতলার বাড়িতে ফেরা। তারপর ৯০ বছরের অসুস্থ শাশুড়ি, দুই মেয়ে রাখি এবং স্বাতীর দেখভাল। সংসারের হাল ঠেলে ফের বিকাল সাড়ে ৩টা নাগাদ মিনিবাসে উঠে আবার স্টিয়ারিং ধরেন প্রতিমা।
রাত ১০-১১টা’র মধ্যে বাড়ি ফেরা। ঘরের মেঝেয় ডাঁই করে রাখা রয়েছে মিনিবাসের টিকিট। খাটে বসে রোজনামচার কথা শোনাতে শোনাতে হেসেই ফেললেন প্রতিমা।
তিনি বললেন, ‘এই সেদিন একজন ড্রাইভারের সিটে আমায় দেখে নেমে পড়লেন। হয়তো ভয় পেয়েছিলেন! অনেকে আবার বলে, লজ্জা করে না! কিন্তু লজ্জা পেলে আমার দুই মেয়েকে ঘিরে যে স্বপ্ন, তা বাস্তব করবে কে! ওদের জন্যই এভাবে লড়াই…।’
দুই মেয়েই জিমন্যাস্ট। বড় মেয়ে রাখি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে থার্ড ইয়ার। ছোট মেয়ে স্বাতী অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বছর তেইশ আগে নিমতার শ্যামাপ্রসাদ নগরের বাসিন্দা শিবশঙ্করের সঙ্গে বিয়ে হয় পাইকপাড়ার প্রতিমার। ঘরকন্না সামলাচ্ছিলেন।
পরে শিবশঙ্করের পরিশ্রম লাঘব করতেই গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নেন প্রতিমা। একটি বেসরকারি হাসপাতালে অ্যাম্বুল্যান্স চালাতেন শিবশঙ্কর। সেই অ্যাম্বুল্যান্সেই গাড়ি চালানোর হাতেখড়ি প্রতিমার। তারপর আট-ন’বছর ধরে মিনিবাস চালাচ্ছেন। কখনও কখনও শিবশঙ্কর চালকের আসনে বসলে কন্ডাক্টরের ভূমিকায় দেখা যায় প্রতিমাকে।
প্রতিমা বলেন, ‘১৯৯৪ সালে বিয়ের পর থেকে গরু সামলানো, দেওয়ালে ঘুঁটে দেওয়া— সব সামলেছি দু’হাতে। সেইসময়ে পাড়ার মধ্যেও এক মাথা ঘোমটা টেনে যেতে হতো। এখন সব বদলেছে। মেয়েরা কি পিছিয়ে থাকবে! তবে এতদিন হয়ে গেলেও এখনও অনেকে অবাক হয়ে আমাকে তাকিয়ে দেখে, মহিলা বাস চালাচ্ছে?’
পাশ থেকে শিবশঙ্কর বলে ওঠেন, ‘অন্য বাস রেষারেষি করলেও আমি ওকে (প্রতিমা) বলি, যাত্রীর যেন কোনও ক্ষতি না হয়, সেভাবেই চলতে হবে। এখনও আমাদের গাড়িতে একজন যাত্রীর গায়ে আঁচড় লাগেনি।’
পুজার সময় মা-বাবার সঙ্গে বেড়ানো হয় না! খারাপ তো লাগেই। তবে মায়ের পাশে বসে হাসিমুখেই মেয়ে স্বাতী বলে, ‘অভাব-অনটন তো বড় সমস্যা। তাই…।’ দুই মেয়েকে ঘরের ভার দিয়ে বিকালের মিনিবাসে উঠে পড়েন প্রতিমা। পুজায় স্বাতী-রাখির মায়ের আগমন এবং গমন, দুটাই মিনিবাসে!
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন