‘কণ্ঠ রোধ করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হচ্ছে’

আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জনগণকে ভয় দেখিয়ে তাদের কণ্ঠ রোধ করতেই সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করতে চায় বলে মত দিয়েছেন সংবিধান বিশেজ্ঞসহ বিশিষ্টজনেরা।

আজ শনিবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে নাগরিক ঐক্য আয়োজিত ‘ডিজিটাল নিরপত্তা আইন ২০১৮’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এমন অভিমত উঠে আসে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, দেশের শাসন ব্যবস্থা থেকে গণতন্ত্রকে স্থায়ীভাবে বিদায় করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে।

শাহদীন মালিক আরো বলেন, ‘একদম এভাবে আইন করার তো প্রশ্নই হয় না। এসব আইন, হয় তারা জানেন না, সেটার ধারণা কম, যেটার সম্ভাবনা কম (অথবা) তারা জানেন এবং জেনে আমাদের দেশটাকে বার্মিজ মডেলে নিয়ে যাচ্ছেন। …আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কথা ধারণ করে (বলব), এই আইন হলে কিন্তু আমরা নিঃসন্দেহে কাউয়া গণতন্ত্র হয়ে যাবো।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, নাগরিকদের হয়রানির সব সুযোগ রেখে করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের যে অপরাধগুলো, সাংবাদিকতা করতে গেলে যে অপরাধগুলার মধ্যে আপনারা পড়বেন সবগুলা অজামিনযোগ্য। এই আইনের জামিনযোগ্য করা হয়েছে সোয়া চারটি অপরাধ।’

আসিফ বলেন, ‘এই আইনের অপর লক্ষ্য হচ্ছে সাংবাদিকতা রুদ্ধ করা। আগামী নির্বাচন নিয়ে, আপনারা জানেন, মানুষের মনে বিভিন্নরকম আশঙ্কা রয়েছে, বিভিন্ন রকমের দুর্ভাবনা রয়েছে। এই নির্বাচন নিয়ে, নির্বাচনকালীন, পরবর্তী সরকারের কার্যক্রম নিয়ে মানুষ যেন ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় থাকে, সেই টার্গেট থেকেই আইনটি করা হয়েছে বলে আমি মনে করি।’

আইনটিকে কালো আইন মন্তব্য করে অবিলম্বে তা বাতিল করার আহ্বান জানন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘মানুষ কথা বলবেই। সুতরাং হাসিনা (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা), এই ভুল করবেন না। এই আইন আপনার জন্য সুবিধা হবে না। আপনি বুদ্ধিমতি মহিলা, বুদ্ধির পরিচয় দেন। স্বাধীন, একটা গণতন্ত্রের পরিবেশ যেটা, আপনার পিতা যে ভুল করেছেন সেটার পুনরাবৃত্তি আপনি করবেন না। সেই ভুলের শাস্তিও আপনার পাওয়া প্রাপ্ত হবে না।’

আইনটির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলে তা বাতিলে সরকারকে বাধ্য করতে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সুশীল সমাজসহ সর্বস্তরের মানুষের প্রতি আহ্বান জানান বক্তারা।

গত ২৯ জানুয়ারি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেছিলেন, ‘এ আইনে সাংবাদিকরা টার্গেট (লক্ষ্য) নয়। সাংবাদিকদের বিষয়ে এই আইনের খসড়ার কোথাও কিছু বলা হয়নি। তাছাড়া এ আইনের মাধ্যমে মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হবে বলেও আমি মনে করি না।’

নতুন এ আইনের খসড়ায় আগের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বহুল আলোচিত ৫৭ ধারাসহ ৫৪, ৫৪, ৫৬ ও ৬৬ ধারা বাতিলের কথা বলা হয়েছে। ৫৭ ধারার ব্যাপক অপপ্রয়োগের অভিযোগ এনে সাংবাদিকরা এ ধারাটি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন। এ ধারাগুলোর পরিবর্তে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশ কিছু ধারা অন্তর্ভুক্ত করে অনুরূপ অপরাধের শাস্তির বিধান করা হয়েছে।

নতুন আইনের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল সিস্টেম ব্যবহার করে ক্ষতিসাধন করলে ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

কারো কম্পিউটার সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত করলে এক বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানার বিধার রয়েছে। ২১ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতার অবমাননা করা হলে অথবা অবমাননায় মদদ দেওয়া হলে ১৪ বছরের কারাদণ্ড অথবা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।

এছাড়া আইনের ২৮ ধারা অনুযায়ী, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ড দেওয়া যাবে। কারো মানহানি করলে তিন বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা, ৩২ ধারা অনুযায়ী সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অতি গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ বা গুপ্তচরবৃত্তি করলে ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে বলেও জানান সচিব।