উপজেলা নির্বাচনে সম্পৃক্ততায় বিএনপিতে দুকূল হারালেন বহিষ্কৃতরা

উপজেলা পরিষদের প্রথম ধাপের নির্বাচনে অংশ নিয়ে দুকূলই হারালেন বিএনপির বহিষ্কৃত নেতারা। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বুধবার অনুষ্ঠিত এ ধাপের ভোটে ৮০ জন নেতা অংশ নেওয়ায় তাদের বহিষ্কার করে দলটি। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে মাত্র সাতজন নির্বাচিত হয়েছেন। ভাইস-চেয়ারম্যান পদে তিনজন জয়ী হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
বাকিরা একদিকে দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন, আবার ভোটেও পরাজিত হয়েছেন। তাদের অনেকের মধ্যেই এখন হতাশা দেখা দিয়েছে। দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও অনেকটা ধ্বংসের মুখে পড়েছে।

দলটির দায়িত্বশীল নেতারা জানান, প্রথম ধাপের নির্বাচনে বহিষ্কৃত নেতাদের অর্ধেক জয়ী হলে চতুর্থ ধাপে বহু নেতা ভোটে অংশ নেওয়ার আশঙ্কা ছিল। প্রথম ধাপের ভোট থেকে শিক্ষা নিয়ে বাকি ধাপের ভোটে অংশগ্রহণ কতটা যৌক্তিক সে বিষয়ে এখন নতুন করে ভাববেন নেতারা। দ্বিতীয় ধাপের ভোট ২১ মে। এখনো সময় আছে এ ধাপে ভোটে যাওয়া বহিষ্কৃতদের ভুল স্বীকার করে দলে ফেরার। নেতারা আশা করেন, বাকি ধাপে নেতাদের ভোটে যাওয়ার সংখ্যা অনেক কম হবে।

এদিকে প্রথম ধাপের ভোটের দিন মাঠে থেকে প্রার্থীদের সহযোগিতা করা নেতাকর্মীদের তালিকা করেছে বিএনপি। কয়েকজন নেতার ব্যাপারে অভিযোগ ওঠার পর সত্যতা যাচাই করতে ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি করেছে কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ থানা বিএনপি।

জানা গেছে, যেসব নেতাকর্মী উপজেলা নির্বাচনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদের ভবিষ্যতে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনে কোনো পদ না দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির ডাকে সাড়া দিয়ে জনগণ ভোটকেন্দ্রে যাননি, বর্জন করেছেন। উপজেলার প্রথম দফার ভোটও জনগণ বর্জন করেছেন। আওয়ামী লীগের প্রতারণার ফাঁদে পা না দিয়ে ভোটাররা উপজেলা ভোটে কেন্দ্রে যাননি। বর্তমান অবৈধ সরকার ও তাদের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে নির্বাচনে ভোটারদের ভোটের প্রয়োজন হয় না। ফলাফল নির্ধারিত থাকে, সেটিই ঘোষিত হয়। এ কারণে ভোট নিয়ে মানুষের কোনো আগ্রহ নেই।’

তিনি বলেন, দলের কিছু লোকজন চুপচাপ বসে থাকে, ওই ধারার নেতারা ভোটে গেছেন। আর হয়তো কিছু টাকা-পয়সা পেয়েছেন, আবার সংস্থার লোকজনও চাপ দিয়ে ভোটে নিচ্ছেন। তবে তা অত্যন্ত নগণ্য। বহু উপজেলায় বিএনপি নেতারা ভোটে যাননি। দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে ভোট বর্জনে তারা কাজ করছেন।

প্রথম ধাপে ১৩৯টি উপজেলা পরিষদে নির্বাচন হয়। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ৮০ জন নেতা এ ধাপের ভোটে অংশ নেন। যাদের আগেই বিএনপির প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরমধ্যে মধ্যে ৩২ জন চেয়ারম্যান পদে, ২৫ জন ভাইস চেয়ারম্যান পদে ও ২৩ জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী ছিলেন।

জানা যায়, বিএনপির বহিষ্কৃত নেতাদের মধ্যে সাতজন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তারা হলেন-বান্দরবান সদর উপজেলায় আব্দুল কুদ্দুছ, শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে আরেক বহিষ্কৃত নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে আশরাফ হোসেন আলিম ও ভোলাহাটে আনোয়ার হোসেন, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলায় মোহাম্মদ আবদুল হামিদ, গাজীপুর সদর উপজেলার ইজাদুর রহমান মিলন এবং সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায় মোহাম্মদ সুহেল আহমদ চৌধুরী। বহিষ্কৃতদের মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় হানিফ আহমেদসহ অন্তত তিনজন। এছাড়া পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় টানা চতুর্থবারের মতো মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন সুলতানা রাজিয়া। তিনি উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তবে নির্বাচনে অংশ নিতে দল থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেন তিনি।

এদিকে বহিষ্কৃতদের মধ্যে যারা নির্বাচিত হতে পারেননি তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা। সংশ্লিষ্ট উপজেলার বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী নেতারা তাদের এড়িয়ে চলছেন। দলীয় সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটে অংশ নেওয়া ভুল ছিল বলেও কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন। প্রথম ধাপে বহিষ্কারাদেশ নিয়েই দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ভোট করে পরাজিত হয়েছেন সরোয়ার হোসেন। তিনি উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন। এক প্রতিক্রিয়ায় সরোয়ার বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। ভোট গণনার সময় ভোটের হার বাড়িয়ে প্রার্থীকে জয়ী করা হয়েছে। বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হয় না-বিএনপির এ দাবি যৌক্তিক ও সঠিক।

দলটির শীর্ষ নেতারা মনে করেন, এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। এছাড়া জাতীয় নির্বাচনের মতো একতরফা উপজেলা নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনরা নিজেরাই দখলের রাজনীতি শুরু করবে। সেখানে টাকার খেলা হবে, ক্ষমতার লড়াই হবে। তাই অহেতুক সাজানো ওই নির্বাচনে অংশ নিয়ে নেতাকর্মীরা মামলা-হামলার শিকার হবে। যেখানে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে না, সেই নির্বাচন বর্জন আবশ্যক। দলের শীর্ষ নেতাসহ তৃণমূল নেতাকর্মীদের এমন মনোভাবের ভিত্তিতে উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। এজন্য সারা দেশে গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণের পাশাপাশি কর্মিসভাও করছেন দায়িত্বশীল নেতারা।

দলটির নীতিনির্ধারকসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের পর্যবেক্ষণ, তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রথম দফার ভোট জনগণ বর্জন করেছে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে যতই ভোটের হার বেশি দেখানো হোক না কেন, তা মানুষ আর বিশ্বাস করবে না। কারণ মানুষ দেখেছে, ভোটকেন্দ্র ছিল একবারেই ফাঁকা।

মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এসএ জিন্নাহ কবির বলেন, ‘জেলার দুটি উপজেলায় ভোট হয়েছে। বিএনপির ভোট বর্জনের ডাকে ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের চেয়েও এই দুই উপজেলার ভোটে জনগণ বেশি সাড়া দিয়েছে। আশানুরূপ জনগণ আমাদের কথা শুনেছে। কিন্তু ব্যাপক পরিমাণে জালভোট দিয়ে ভোটের হার বাড়িয়েছে, অথচ ভোটাররা কেন্দ্রে যাননি।’

নওগাঁ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু বক্কর সিদ্দিক নান্নু বলেন, ‘জেলার তিন উপজেলায় প্রথম ধাপে নির্বাচন হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ডাকে জনগণ সাড়া দিয়ে ভোট বর্জন করেছে। সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে গিয়েছে।’

এদিকে দলটির দায়িত্বশীল কয়েকজন নেতা জানান, নেতাদের ভোট থেকে বিরত রাখা ও বর্জনের বিষয়ে বিএনপির সাংগঠনিক টিম শুরু থেকেই কাজ করছে। তারা জেলায় জেলায় কর্মিসভার পাশাপাশি স্থানীয় নেতাদের নিয়ে লিফলেট বিতরণও করছে। তবে কয়েকজন সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উপজেলা পরিষদের প্রথম দফার ভোটে ওইসব দায়িত্বশীল নেতাদের নিজ এলাকায় ভোটের হার বেশি হওয়ায় বিষয়টি ভালোভাবে দেখছে না হাইকমান্ড।
একজন নীতিনির্ধারক জানিয়েছেন, বুধবার প্রথম ধাপের ভোটে সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলায় ৭৩.১৬ শতাংশ। অথচ ওই উপজেলা বিএনপির একজন দায়িত্বশীল নেতার নির্বাচনি এলাকার মধ্যে পড়েছে।
সূত্র:যুগান্তর